মতামত

ফাও মাননীয়র মৌসুমি দৌড়

নির্বাচনী ডামাডোলে ফাও মান্যবর প্রার্থীরা মহাব্যস্ত। আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা বাদ দেয়া তাদের জন্য শুভ সংবাদ। প্রাথমিক লক্ষণ ভালো দেখছেন তারা। এমনিতেই কিছু ব্যক্তি নানান জায়গায় ছুটছেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ধরনের নির্বাচনে মাননীয় হওয়ার আশায়। বিনাভোটে এমপি হওয়া, পাঁচ বছর নিরাপদে, শান-শওকতে কাটিয়ে দেয়ার গ্যারান্টি আগে বুঝলে সেই নির্বাচনেও অনেকেই ভিড়তেন এ দলে। বুঝে-শুনে এবার ঘটনাচক্রে সেই ধরনের অপেক্ষমানের সংখ্যা ১৫৩ নয়। অগুণতি। সেই আশায় সম্ভাব্য সবদিকেই ঢুঁ মারছেন তারা।

Advertisement

আগে সকল প্রার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক ছিল আয়কর রিটার্ন দাখিল। এবার তা শিথিল করা এই শ্রেণিটির জন্য প্রাক-সুসংবাদ। মানুষ না চিনুক, নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান না থাক, কোনো দলের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ততা না থাক- এমন টাইপের অনেকেও বিভিন্ন এলাকায় ঘুরছেন। টুকটাক খরচ করছেন। স্বজন-প্রতিবেশি জুগিয়ে চেষ্টা করছেন হাট-বাজারে আলোচনার খোরাক হতে। তাদের ধারণা, দশম সংসদে তাদের তুলনায় অচেনা-অজানা কেউ কেউ ফাঁকা মাঠে বাজিমাত করেছেন। কারো কারো প্রতিযোগিতাও করতে হয়নি। বিনাভোটেও এমপি হয়ে গেছেন।

এবারও সেই ধরনের ঘটনাচক্রের আশায় এই শ্রেণির কেউ কেউ রীতিমতো পাগলপারা। স্থানীয় বড় দুদলের পাশাপাশি অন্যান্য ছোটখাট দলের অফিসেও চা-নাস্তার খরচ জোগান দিচ্ছেন। মুদি দোকানদার থেকে ফুটপাথের ব্যবসায়ী, বড় ব্যবসায়ী থেকে অবসর নেয়া আমলাসহ অনেকেই রয়েছেন এ ‘যদি লাইগ্যা যায়’ লবিংয়ে।

থার্ড-ফোর্থ গ্রেডের শোবিজ তারকা থেকে নামিদামি অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকাও রয়েছেন এ তালিকায়। রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সেনা-পুলিশ, কাস্টমস কর্মকর্তা, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। প্রবাসী বিত্তশালীও মাঠ দাবড়াচ্ছেন কোথাও কোথাও। এলাকায় নতুন মাল, আদম, মুরগা ইত্যাদি নামে সম্বোধিত তারা।

Advertisement

স্বাভাবিকভাবেই এদের ঝোক বেশি ক্ষমতাসীন দলের দিকে। কারণ দেশে সবকিছুই এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক। যারই কিছু অর্থ ও পরিচিতি হয়েছে তিনিই ক্ষমতার ধারে-কাছে ঘেঁষতে চান। অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সুদের বেশিরভাগই মনে করেন একবার এমপি হতে পারলেই নিজের প্রতিপত্তিকে নতুন মাত্রা দিতে পারবেন। আবার কারো কারো চাওয়া অন্তত এমপির কাছের লোক বা শক্ত প্রতিপক্ষ হওয়া। এটিও ক্ষমতার সিঁড়ি। তাদের বাইরে কেউ কেউ ঘুরছেন অন্যান্য দলের পেছনে। ঘটনাক্রম ৫ জানুয়ারির মতো জাতীয় পার্টি, বিভিন্ন জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি বা স্বতন্ত্র হিসেবে ভাগ্য খুলেও দিতে পারে বলে লাক ট্রাই করতে সমস্যা কোথায়?

এই শ্রেণিকে নিয়ে মাঠে বিরক্তিও কম নয়। তা বেশি আওয়ামী লীগে। এরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রী ভাব নেয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বড় বড় নেতাদের নাম বিক্রি করছেন। সেলফি দেখাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হচ্ছেন, দাওয়াত কার্ডও শো করছেন। বিশেষ কোনো কারণ বা পরিস্থিতিতে শেষমেষ এরা দলীয় টিকিট হাতিয়ে ফেলেন কি-না, এমন আতঙ্কে ক্ষমতাসীনদলের জাঁদরেল কেউ কেউও।

সরকারে শরীক জাতীয় পার্টির হয়েও এ ধরনের কিছু লোকের আমদানি ঘটেছে কিছু কিছু এলাকায়। চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক, যুগল ছবির শো-ডাউনও রয়েছে কোনো কোনো এলাকায়। এবারের নির্বাচনে তারা জাতীয় পার্টি থেকে মহাজোটের প্রার্থীতার সবুজ সংকেত দিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্যানিকে ফেলছেন। যা অনেকটা ব্ল্যামেলিংয়ের মতো। ক্ষোভে ফুঁসলেও অনিবার্য কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে বা করতে পারছেন না।

সঙ্গত কারণেই বিএনপিতে এ ধরনের আপদ কম। দলটিতে এমনিতেই প্রতি আসনে তিন-চারজন, কোথাও কোথাও আরো বেশি প্রার্থী অ্যাকটিভ। মামলা, হয়রানি, এলাকাছাড়া থাকাও তাদের যোগ্যতার একটি মানদণ্ড । তাদের কেউ কেউ শুধু ঢাকা নয়, লন্ডনেও ঘোরাফেরা করে নিজের পজিশনের বার্তা দিচ্ছেন। তাদের বাইরে শরীক হিসেবে খুচরা দলের নেতাদের মহড়া রয়েছে কোনো কোনো এলাকায়। জোটের প্রধানদল বিএনপির হাইকমান্ডে তাদের যাতায়াত ও নিশ্চয়তার নানা তথ্য ছাড়ছেন এলাকায়।

Advertisement

এই মহলের কেউ কেউ আবার সদ্যগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল-মান্নাদের সঙ্গে বিশেষ খাতিরের প্রচারণা রটাচ্ছেন। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে কোনো কোনো এলাকায় উল্টো কার্যকলাপও রয়েছে। আগে বিএনপির মনোনয়ন চাওয়া ব্যবসায়ী-আমলাকে এবার নৌকার মনোনয়ন চেয়ে পোস্টার ছাপিয়ে ও বিশালাকার নৌকা বানিয়ে ব্যতিক্রমি শোডাউন যোগ হয়েছে । টাকার জোরে দেশে সব সম্ভব-এমন বাজারদরি কথার জোরে তারা মাঠ গরমের চেষ্টা করছেন। মনোনয়ন না দিলেও অন্য কিছু দিয়ে তাদের আয়ত্বে রাখতে হতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে বেশ ক’টি আসনে।

এ ধরনের লোকদের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক জোট ভোটে আসুক, না আসুক- পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে অনেককে পেতে চায় তারা। তাই বেশি সংখ্যক পার্টনারের খোঁজে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি ছাড়াও ডান-বাম, ধর্মভিত্তিক দলে মাঠ সরব রাখার কৌশল আওয়ামী লীগের। ক্ষমতাসীনদলের এমন মনোভাব ফাও বা ঘটনাচক্রে মান্যবর হওয়ার প্রতিযোগীদের জন্য অনুকূলে।

হাল বুঝে তারা নিজ গরজেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওঠাবসা করছে। তাদের বিশেষ নজর হেফাজতে ইসলাম, প্রয়াত মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, আটরশি পীরের দল জাকের পার্টি, বিএনপি জোটে থাকা অলি আহমদের এলডিপি, বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা বা যুক্তফ্রন্টের দিকে। কোনো কারণে তারা যেন বিগড়ে না যায়, বিরোধী কোনো জোটে না যায়, সেটাও নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।

 

২০১৪ সালে এসব দলের নেতারা এমনটি ভাবেননি। ৫ জানুয়ারিতে বিনাভোটে ১৫৩ জন নির্বাচিত হওয়া, অচেনা-অজানা লোকের মাননীয় হওয়ার কথা ভাবতে পারেননি তারা। জয়ী হবার পর পাঁচ বছর এভাবে টিকে যাওয়াও অনেকটা মিরাকেল। সেটা ভাবতে না পেরে বিএনপির দেখাদেখি তারাও নির্বাচনে যাননি। তাই এবার নতুন ভাবনায় পেয়েছে মান্যবর হওয়ার দৌড়ে মোহাচ্ছন্যদের মধ্যে। এমন মোহের কথা লুকিয়ে রাখতে পারেননি গাজীপুরের কাজী আবুল হোসেন মাস্টার।

কাগজে-কলমে স্বচ্ছতার সঙ্গে তিনি জানিয়ে ফেলেছেন তার মনের কথা। ভণিতায় না গিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন আবুল মাস্টার। তার ইচ্ছা একাদশ জাতীয় সংসদে গাজীপুর-৩ আসনের এমপি হওয়ার। গাজীপুর সদর উপজেলা যুবলীগ সভাপতি পরিচয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সিইসির কাছে লেখা চিঠির সঙ্গে নির্বাচনী ইশতেহারও যুক্ত করেছেন। জানিয়েছেন ছোটবেলা থেকেই তার এমপি হওয়ার শখ। তিনি জানতে পেরেছেন গতবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকেই এমপি হয়েছেন। তাই এবার ভোটের আগে তিনি সেই প্রস্তুতি শুরু করেছেন।

আবুল হোসেন মাস্টারের এমন আকাঙ্খার নৈতিকতা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা কি হেলাফেলার মতো? নানা সমালোচনা-নিন্দা থাকলেও ৫ জানুয়ারির এমপিরা বাংলাদেশের এর আগের সংসদের এমপিদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি ক্ষমতাবান। প্রাপ্তিও ঢের। রাজধানীর স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে পার্কিং করে রাখা প্রাইভেটকারকে সরিয়ে নিতে অনুরোধ করে পুলিশ সার্জেন্টের এক নারীর আক্রমণের শিকার হওয়া তো মাত্র কদিন আগের ঘটনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছিল জম্পেশ আলোচিত।

এতে দেখা গেছে, ঝোটন সরকার নামের এক ট্রাফিক সার্জেন্ট ওই নারীর কাছে জানতে চান, আপনি গাড়ি ডাবল করে মানুষকে হয়রানি করছেন কেন? এরপর ওই গাড়ির ছবি তোলার চেষ্টা করলে ওই নারী বলেন, ‘এই কার গাড়ির ছবি তোলো? এটা সরকারি দলের লোকের গাড়ি। কয় টাকা বেতনে চাকরি করে তোমার মতো সার্জেন্ট? আমরা প্রধানমন্ত্রীর লোক। আমার বাবা এমপি।

পরে নিজের ফেসবুকে ছবি ও ভিডিও দিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন সার্জেন্ট ঝোটন সরকার। কিন্তু পরে জানা গেছে, ওই ভদ্র মহিলা মোটেই এমপি কন্যা নন। একজন মেন্টাল রোগী। ততক্ষণে মানুষ খবরটি লুফে নিয়েছে হটকেকের মতো। কারো কারো মধ্যে এ ধরনের সংবাদ লুফে নেয়ার এক ধরনের অপেক্ষাও থাকে।

আবার পথে-ঘাটে এ ধরনের কাণ্ডকীর্তি ঘটছেও। এমপি, এমপি পুত্র-কন্যা, এমপির ভাই-বোন, স্বজন পরিচয়ে সেই বাহাদুরির সুযোগ বেশি। এর আগে, এক এমপি পুত্রের বেপরোয়া গাড়ির চাপায় রাজধানীর মহাখালিতে নিহত হয়েছে এক পথচারী। নোয়াখালীর এক এমপির গুণধর ছেলে সাবাব চৌধুরীর ওই কাণ্ড ঢাকা দেয়া হয় ক্যাশ টাকায়। এরও আগে, রাজধানীতে চলতি পথে সমস্যা মনে করে রাজধানীর ইস্কাটনে দুজনকে গুলিতে ‘নাই’ করে দিয়েছেন আরেক মাননীয়র ছেলে রনি। কিছুদিন আগে, ঢাকার এক মাননীয় সাংবাদিককে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘আমি কে চেন? জান আমি কি করতে পারি?’

৫ জানুয়ারির বিনাভোটের নির্বাচন এ ক্ষেত্রে কতোটা দায়ী, তা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। ১৫৩-র বাইরে নামী-দামী অনেকেও এর একেবারে বাইরে নন। সেইসঙ্গে তাদের স্ত্রী-স্বামী, সন্তান, ভাই-ব্রাদারসহ ওয়ারিশগণের কাণ্ডকীর্তি যোগ করে চলছে বাড়তি মাত্রা। মাননীয়, মান্যবর, সম্মানীয়, মহোদয় ধরনের সম্বোধনগুলো তাদের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত এ ৩’শ জন সাংবিধানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ক্রিয়াকর্মে এমপি এখন কোথাও কোথাও হাসির পাত্র। নানান মশকরা হচ্ছে তাদের নিয়ে।

কোনো দেশের জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে এ ধরনের রস-মশকরা জাতির জন্য কষ্টের। দেশটির জন্য লজ্জার। স্বাধীনতার পর বাহাত্তরে এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল প্রায় শতভাগ। ওই সময় দেশে প্রচুর রিলিফ এসেছিল বিদেশ থেকে। এরসঙ্গে মিল রেখে বাহাত্তরে এসএসসি পাসদের ঠাট্টা করে মানুষ বলতো রিলিফের মেট্রিক পাস। কোনো কোনো এলাকায় বাহাত্তুরা পাসও বলা হয়। ঘটনাচক্রে ডিজিটাল যুগে এসে ৫ জানুয়ারির বদৌলতে দেশে জন্ম হয়েছে রিলিফের এমপি। তাদের ডিকশনারিতে ত্রুটি বা অন্যায় নেই। পারলে আরেকটু বেশি করছেন তাদের ওয়ারিশরা ।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর