সাহিত্য

শিল্পচৈতন্যে সেলিম আল দীন

আমরা দেখেছি  সেলিম আল দীন-এর (১৮আগস্ট ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি ২০০৮) সৃষ্ট নাটকসমূহ বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের এক বিশাল সম্পদ এবং তা সর্বক্ষণ আমাদের শিল্পচিন্তার জগৎকে মথিত করে চলেছে। আমাদের সামগ্রিক শিল্পচিন্তার তিমির ক্ষেত্রেও করে চলেছে অনবরত আলোক সঞ্চার। তাই কেবল বাংলা নাট্য সাহিত্যই নয় -হাজার বছরের বাঙালির নাট্য ও জীবন দর্শনেরও তিনি নবতর ব্যাখ্যাতা বলে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তাঁর রচিত নাট্যে মানব জীবন ও প্রকৃতির যে চিত্রভাষ্যের প্রকাশ ঘটে তা যেন কোন এক অমর চিত্রকরের একটানে আঁকা চিত্রকলা। আর এই চিত্রকলার মুঠোর ভিতর হাজার বছরের বাঙালির তাবৎ জীবন সংগ্রাম যেন মুহূর্তেই চঞ্চল নৃত্যে মুখর হয়ে ওঠে। আর নৃত্যরত মানুষ ও প্রকৃতির সংশ্লেষে তাঁর লেখায় জীবনের গভীর অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর ক্রমাগত যে রূপ মুদ্রিত হয়ে ওঠে তা একদিকে যেমন এই ভূমিজাত বাঙালির একান্তই নিজস্ব; অপরদিকে তেমনি আবার আধুনিক দৃষ্টি ভঙ্গিজাত এবং বৈশ্বিক বোধ সম্পন্ন।নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন মানব জীবনের সামগ্রিক এই বোধ অর্জন করেছিলেন অনুসন্ধিৎসু প্রত্ন-গবেষক সুলভ  দৃষ্টির প্রখরতায় বাঙালির হাজার বছরের সংস্কার-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচার থোকে। শুধু তাই নয় বিশ্ব সভ্যতা বিকাশের নানামুখী সঙ্কটকালে কখনো জীবন সংগ্রামের তাগিদে কখনো বা নানা জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধজাত মানব জীবনের গভীর প্রশ্নতাড়িত সহস্র সমস্যাবলী থেকে। ফলে অকাল প্রয়াত এই নাট্যকারের নাটকে মানব জীবনের গভীর সঙ্কট আর বিশ্বব্যাপ্ত সমস্যার সূত্রাবলী উন্মোচিত হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের ভিতরকার অপার রহস্য। আর এই উন্মোচনের মাধ্যমে আধুনিক মানুষের বিবেক বোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে অনবরত। এরূপ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বিমোক্ষণজাত যে ফলপ্রাপ্তি আমাদের ঘটে তার আলোকে আমরা নিজেদের অন্তর্গত মানবিক ও  বিশ্ববোধকে পরিশুদ্ধ করে তুলতে পারি। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের পক্ষে এ সবই সম্ভব হয়েছিল সভ্যতা ও মানব ইতিহাসের দীর্ঘ পটভূমির ওপর তিনি তাঁর শিল্পভাবনার অভিলাষী আকাঙক্ষা নিয়ে শক্তভাবে দণ্ডায়মান ছিলেন বলে। দণ্ডায়মান ছিলেন বাঙলার মাটি, জল, কুয়াশা, আলো, হাওয়া, বনস্থালী আর ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তমান আকাশের বর্ণিল বিভাসহ চন্দ্র, সূর্য ও অজস্র নক্ষত্ররাজির নিবিড় সূত্র এক শিল্পসূতোয় গাঁথা আকাশচারী সেতুবন্ধের সন্ধিক্ষণে। সেলিম আল দীন পিঁপড়ে, পোঁকা, সাপখোপ, পাখি, কচ্ছপ, গাছগাছালি, আরণ্যক জনপদসহ ছিন্নমূল অরণ্যবাসীর আনন্দ বেদনা, জীবনচর্চা ও ধর্মবিশ্বাসের গভীর মর্মমূলে মমতার চোখ মেলে দিয়েছিলেন বলে আমরা তাঁর রচনায় আদিম মানুষের শিল্পিত আর্তনাদও দেখি।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই আমরা দেখি সৃষ্টিশীল শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে স্বভূমি, জাতীয়তা এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে মানব কল্যাণের প্রতি নিবেদিত হওয়ার প্রবণতা। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনও সৃষ্টিশীল সেইসব শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রেরণার বিস্তারকে পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে আদর্শরূপে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বলে রাখা ভালো যে, তাঁর পথ ছিলো অনেকটাই স্বতন্ত্র এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অনেকেরই একেবারে বিপরীতমুখা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত সমকাল কিংবা তৎপরবর্তীকালে স্থিত সামাজিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নানা দেশের নানারূপ শিল্প আন্দোলন ছাড়াও শিল্পচিন্তার ক্ষেত্রে সেলিম আল দীন পটভূমি হিসেবে পেয়েছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ ষাট দশকের বাঙালির সমস্ত জাতীয় আন্দোলন। একদিকে ষাট দশকের স্বাজাত্য বোধজাত আন্দোলনে সৃষ্ট প্রখর স্বাদেশিক অনুভূতি, স্বভূমির প্রতি তীব্র মমত্ববোধ, আর এদেশের মানুষ ও সমাজব্যবস্থাপনার প্রতি গঠনমূলক অঙ্গীকারসহ সত্তর দশকের শুরুতে সংঘটিত বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির সমগ্র আন্দোলনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লে­খ্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।বাঙালির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে উপলব্ধি করা যায় যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এদেশবাসীকে সর্বক্ষেত্রে নবতর প্রেরণায় কর্মনিষ্ঠ করে তুলেছিল। কি কর্মী, কি শিল্পী, কি সাহিত্যিক সকলেই স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে যে যার মতো আত্মপ্রতিষ্ঠার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেছিল সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশে মঞ্চনাটক চর্চার ক্ষেত্রে এই কর্মোদ্যোগ সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখেছিল বলে সকলেই স্বীকার করেন। আচার্য সেলিম আল দীন যুদ্ধজাত সমাজব্যবস্থায় তাঁর স্বভূমি, জাতীয় চেতনা আর এই দেশজ শ্রেণিবর্ণ নির্বিশেষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি স্বীয় মনোযোগকে গভীরতার সঙ্গে নিবদ্ধ করেছিলেন। আধুনিক জীবনের শৈল্পিক চেতনাবোধ নিয়ে তিনি তাঁর লেখার বিষয় করেছিলেন প্রথমত এই দেশ, এই ভূমিজাত মানুষের সমস্যা, সঙ্কট ও সম্ভাবনাকে। পাশাপাশি, অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে সকল বর্ণগোষ্ঠীর মানুষের মানবীয় সত্ত্বাকে প্রকাশের চেষ্টায় উন্মুখও ছিলেন তিনি। আর এই প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে প্রকৃতপক্ষে তিনি বাঙালির এক নস্টালজিক পরিবেশের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন আমাদের মগ্ন চেতন্যের অন্তর্জগতে। আমরা তাঁর নাটকসমূহের প্রায় সর্বত্রই পেয়ে থাকি বাঙালির ঐতিহ্যিক ও গোষ্ঠী জীবনের নানারূপ আচার, পার্বন, কৃত্য, সংস্কার ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী আমাদের পূর্বপুরুষের বর্ণাঢ্য জীবন সংগ্রামকে। দ্বিতীয়ত তিনি মানবসৃষ্ট যুদ্ধ, রাষ্ট্রদর্শন আর রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্পর্কিত প্রচলিত নিয়মনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন মৌল মানবিক মূল্যবোধের তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে।বর্ণিত সব নিয়ামক নাট্যকার সেলিম আল দীনকে ‘আচার্য’ সেলিম আল দীনে পরিণত করে তুলেছিল। তাঁর এই পরিণতির প্রেক্ষাপট হিসেবে কেবল তাঁর বিচিত্র রীতির রূপরস বর্ণগন্ধময় নাটকগুলোই ক্রিয়াশীল ছিল না- আমরা জানি গভীরতরসূত্রে ক্রিয়াশীল ছিল সেলিম আল দীনের শিল্প ও নন্দনতাত্ত্বিক সূত্রসমূহও। সেলিম আল দীনের নাটকের মতো তাঁর শিল্প সূত্রসমূহও পটভূমি হিসেবে গ্রাস করেছিল আবহমানকালের বাংলা ও বাঙালির বর্ণিল জীবনের পটভূমি। তাই পাশ্চাত্য শিল্পবুদ্ধির আবেশায়নে বিভ্রান্তির উৎকেন্দ্রিক পথে সেলিম আল দীন হাঁটেন নি কোন দিন। তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল পাশ্চাত্য পণ্যসভ্যতার সর্বগ্রাসী সংবর্ত থেকে বাঙালির শিল্প ও শিল্পতত্ত্ব প্রাচ্যের বিবেচিত পথেই বিশ্বসাহিত্যের স্রোতধারাকে উজ্জ্বল  করে তুলতে সক্ষম। তাই দৃঢ়তার সাথে তিনি তাঁর শিল্পচেতনায় অবস্থান করেন স্বদেশ ও স্বভূমির বিস্তৃত পটভূমিকায়।আচার্য সেলিম আল দীন আজ নেই। কিন্তু তাঁর শিল্পচিন্তা আমাদের সহায় ও সহচর। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমরা বিমর্ষ বোধ করি। কিন্তু তাঁর নির্দেশিত শিল্প পথ থেকে আমাদের বিচ্যুতি ঘটে না। ক`বছর আগে তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন একথা আমরা জানি। কিন্তু আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এও মানি যে, শারীরিকভাবেই কেবল তাঁর লোকান্তর ঘটেছে মাত্র। এই লোকান্তরের ফলে তিনি আজ আমাদের শিল্প আসরে অনুপস্থিত। কিন্তু তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি আমাদের কাছে তখন তুচ্ছ মনে হয় যখন আমরা গভীর শিল্পচৈতন্যে চারপাশকে সেলিম আল দীনের ভাবনাবিশ্বের বিস্তারে আবৃত হতে দেখি। বিবেচনা করি, শিল্পতীর্থগামী যে কোন অভিযাত্রীর অভিষ্ট লক্ষ্যের পথে আচার্য সেলিম আল দীন যে শিল্পরেখার পাদস্পর্শ রেখে রেখে পৌঁছে ছিলেন আকাশ ও নক্ষত্রলোকে তারই চেতনার স্ফুরণ নব্যকালের শিল্পীদের নৃত্য-গীত-বাদ্য ও নাট্যের ঝংকারে আসরে আসরে অভিনীত হয়ে চলবে অনাদিকাল।এইচআর/আরআইপি

Advertisement