প্রবাস

গ্রিসে ভয়াবহ দিন কাটছে সজীবের!

‘দেশে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। ভালোই চলছিল। আরো ভালো থাকার আশায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম ইউরোপে যাওয়ার। তবে আমার শেষটা খুব কষ্টের। এখন আমার এমনই দুরবস্থা দেশে ফিরতে পারবো কিনা জানি না। হায়রে জীবন! বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছি। আগে জানলে কখনোই এত বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিতাম না। লোভে পাপ পাপেই যত সর্বনাশ!’

Advertisement

বলছিলাম সম্প্রতি গ্রিসে অবস্থানরাত সজীব নামে এক বাংলাদেশির কথা। তিনি ইতালি যাওয়ার জন্য মাফিয়া চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর তাকে দালাল চক্র লিবিয়ায় পৌঁছে দেয়। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর স্পিডবোট হয়ে গ্রিসে পাড়ি জমায়। গ্রিস থেকে ইতালি কিংবা জার্মানিতে পৌঁছে দেবে। সেভাবেই চুক্তি করা ছিল এ দালালদের সঙ্গে।

‘দালাল চক্র আমাকে বলেছিল যত টাকা চুক্তি করা হবে তার অর্ধেক নগদ দিতে হবে আর বাকিটা পৌঁছানোর পর। তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করেছি। বলেছিল যদি টাকা দিতে ঝামেলা করি তাহলে আমার সমস্যা করবে। আর কথা অনুযায়ী টাকা দিলে ভালোভাবে আমাকে পৌঁছে দেবে। এমনকি আমাকে চাকরিতে লাগিয়ে দেবে।’

‘দালাল চক্র আমাকে গ্রিসে পৌঁছে দিয়েছে তবে কাজ দেয়নি। এখন বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে চলছি। থাকছি একটা শরর্ণাথী ক্যাম্পে। কবে কাজ মিলবে বুঝছি না। তবে ইচ্ছে আছে ইতালি কিংবা জার্মানি পাড়ি জমাবো। শুনছি বর্তমানে জার্মানির অবস্থাও নাকি খারাপ। সেখানেও ধরপাকড় চলছে। ইতালিতে অভিবাসীদের জন্য নতুন আইন করেছে। কি যে করি বুঝছি না।’

Advertisement

কিভাবে গেলেন জানতে চায়লে তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে লিবিয়া যেতে দশ হাজার ডলার দিতে হয়েছে। আর নৌকা খরচ দিতে হয়েছে ৭০০ ডলার। আর খাবার দাবার অন্যান্য খরচ তো আছে। দালালদের বিভিন্ন পর্বে পর্বে টাকা দিতে হয়েছে। তবে লিবিয়া থেকে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসার সংখ্যা বাংলাদেশিই সবচেয়ে বেশি।’

আরও পড়ুন>> অথৈ সাগরে আল্লাহই ছিল ভরসা

তিনি বলেন, ‘আফ্রিকা ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে নৌপথে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর কিংবা আটলান্টিক মহাসাগর স্পিডবোট কিংবা ট্রলার দিয়ে পাড়ি জমানোর সময় সলিল সমাধি হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। সাহারা মরুভূমি হয়ে পর্তুগাল ঢোকার চেষ্টাকালে সাহারা মরুভূমির দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনাহারে অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।’

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে মাত্র একজন বাংলাদেশি ইতালিতে প্রবেশ করলেও ২০১৭ সালে একই সময়ে ২ হাজার ৮০০ জন ইতালিতে প্রবেশ করে। এছাড়া চলতি বছরেও বেশকিছু বাংলাদেশি ইউরোপ প্রবেশকালে আটক হয়ে লিবিয়া কারাগারে রয়েছে। কোন একক দেশ থেকে ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সংখ্যার হিসেবে এটাই সর্বোচ্চ।

Advertisement

উদ্ধারকর্মীরা জানান, ঢাকা থেকে লিবিয়া বা তুরস্ক যেতে একজনকে দশ হাজার ডলারের বেশি অর্থ দিতে হয়। একটি এজেন্সি তাদের লিবিয়া পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেয়। ওয়ার্কিং ভিসার জন্য এজেন্সিকে ৩ থেকে ৪ হাজার ডলার দিতে হয় বলেও জানিয়েছেন তারা।

আইওএম’র মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রথমে অভিবাসীদের দুবাই ও তুরস্কে নেয়া হয়। এরপর বিমানে করে তারা লিবিয়া পৌঁছান। বিমানবন্দরে কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং কাগজপত্র নিয়ে যান।

লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় লিবিয়ার কারাগারে ২৮০ জন বাংলাদেশি নাগরিক বন্দি রয়েছেন।

ইউরোপের অন্যতম প্রবেশপথ স্পেন সফর করে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে স্পেনে যারা এসেছেন তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বর্তমানে মানব পাচারকারী দালাল চক্ররা এখন ইউরোপে ঢোকার জন্য যুদ্ধবিধস্ত লিবিয়াকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। দালালদের মাধ্যমে আসা বেশিরভাগ বাংলাদেশি চেষ্টা করেন লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে ইউরোপের দেশ গ্রিস কিংবা ইতালিতে অনুপ্রবেশের।

অনেক বাংলাদেশি দীর্ঘদিন লিবিয়াতে বাস করার পর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন। আবার অনেকেই আছেন কিছুদিন আগে সেখানে পৌঁছেছেন। তারা সরাসরি ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। আইওএম-র তথ্য অনুসারে, একজন বাংলাদেশি অভিবাসীকে লিবিয়া যেতে ১০ হাজার ডলার এবং ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য নৌকা খরচ দিতে হয় ৭০০ ডলারের মতো।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে অপসারণে সামরিক অভিযানের পর লিবিয়ায় অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ইসলামিক স্টেট এবং একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ সেদেশে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানবপাচারকারীরা সক্রিয় হয়েছে এবং বিশাল অংকের অর্থ আয় করছে।

এমআরএম/এমএস