কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ৬৫১টি ঘরে নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকল্প থেকে লুটপাটের জন্য ঘর নির্মাণে প্ল্যান, ডিজাইন প্রাক্কলন মোতাবেক গুণগত মান বজায় রাখা হয়নি।
Advertisement
সেইসঙ্গে তালিকায় অসচ্ছল ব্যক্তিদের পরিবর্তে সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্তিকরণ, ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী, দায়সারাভাবে ঘর নির্মাণসহ সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে পরিবহন খরচসহ বিভিন্ন উপকরণ নেয়া হয়েছে।
সুুুবিধাভোগীদের অভিযোগ, ঘর নির্মাণে মানা হয়নি সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়ম। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিটি ঘর। ঘরের খুুঁটির দৈর্ঘ্য ১২ ফিট এবং বারান্দার খুঁটি ১০ ফিট দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে ১০ ফিট। খুঁটির প্রস্থ ৪ বর্গ ইঞ্চি হওয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে অনেক কম। রডের পরিমাণে রয়েছে গরমিল। খুঁটিতে দেয়া হয়েছে ১ সুতা রড। ঘর ও বাথরুম নির্মাণে ২১টি খুঁটির পরিবর্তে দেয়া হয়েছে ১৯টি খুঁটি। কাঠ এবং মেঝের মানে রয়েছে ঘাপলা। প্রথম শ্রেণির ইট দিয়ে দেয়াল ৮ ইঞ্চি করার কথা থাকলেও করা হয়েছে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি। ব্যবহার করা হয়েছে তৃতীয় শ্রেণির ইট। মেঝেতে একই ধরনের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মেঝে পাকাকরণের কাজে বালু এবং পলিথিন কিনে দিতে হয়েছে সুবিধাভোগীদের।
কেদার ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সুবলপাড় গ্রামের অসচ্ছল নারী দুলালী বলেন, ঘর নির্মাণের যাবতীয় উপকরণ পরিবহন, পলিথিন, বালু, ধর্নার বাঁশ আমি কিনে দিয়েছি। এতে ৪ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে আমার।
Advertisement
একই কথা বলেছেন কচাকাটা ইউনিয়নের তরিরহাট এলাকার রওশনারা, বল্লভের খাষ ইউনিয়নের দামাল গ্রামের আমির আলী ও হাসনাবাদ ইউনিয়নের হালিমা বেগমের স্বামী কলিমুদ্দিন। তারা বলেন, ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং দুই বস্তা করে সিমেন্ট কিনে দিয়েছি ঠিকাদারকে। পরে আমাদের ঘর দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের ঠিকাদার আকতার হোসেন বলেন, ১ লাখ টাকা বরাদ্দের ঘরের কাজের মধ্যে কাঠ, বালু, ইট, পলিথিন, নির্মাণব্যয় এবং বাথরুম বাবদ ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা করে যুক্তি হয়েছে। টিন, খুঁটি এবং পরিবহনের বিষয়টি ইউএনও জানেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেদার ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিনমজুর মজিবর রহমানের স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সাত সদস্যের সংসার। থাকার মতো কোনো ঘর নেই তাদের।
মজিবর রহমান বলেন, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পেছনে পেছনে ঘুরেও মেলেনি একটি ঘর। ঘর দেয়ার কথা বলে মেম্বার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন। পরে ঘরের কথা বললে তিনি বলেন জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলেছেন।
Advertisement
একই অবস্থা কচাকাটা ইউনিয়নের দক্ষিণ সরকারটারি গ্রামের ফজিরন বেওয়ার। তারও থাকার কোনো ঘর নেই। ফজিরন বলেন, বছরের পর বছর ধরে ঝুপড়ি ঘরে থাকছি। মেম্বারকে অনেক অনুরোধ করেছি, কিন্তু ঘর দেননি।
অথচ ফজিরন বেওয়ার পাশেই স্থানীয় মেম্বারের জামাতা রোকনুজ্জামান রোকন পেয়েছেন সরকারি ঘর। সচ্ছল পরিবার হয়েও সরকারি ঘর হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বল্লভের খাষ ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সাইফুর রহমান বলেন, তালিকায় আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা তহসিলদারের ভাগ থেকে দু’একটা নাম নিয়েছি। সে অনুযায়ী ঘর বণ্টন করেছি।
রায়গঞ্জ ইউনিয়নে সরকারি ঘর নিয়ে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হেল বাকী মাসুম। তিনি বলেন, এই প্রকল্পের সদস্য থাকলেও কোনো কিছুই আমার জানা নেই। সব কিছু করেছেন প্রকল্প সভাপতি ইউএনও। তালিকা প্রস্তুতে অনিয়মসহ নির্মাণে রয়েছে অনিয়ম। একটি ঘর নির্মাণে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বাকিটা ব্যক্তি পকেটে চলে গেছে।
প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শঙ্কর কুমার রায়। তিনি বলেন, উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন দিক ম্যানেজ করতে কিছুটা অনিয়ম হয়েছে। তবে বড় ধরনের অনিয়ম হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এই উপজেলায় ৬৫১টি ঘরের বিপরীতে ৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। প্রতিটি ঘরের ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ টাকা। ঘর নির্মাণ শেষে বাড়তি টাকা সুবিধাভোগীদের ফেরত দেয়ার নিয়ম থাকলেও এখন পর্যন্ত কেউ পায়নি এই টাকা।
নাজমুল/এএম/পিআর