ভ্রমণ

কানাডায় সড়ক পথে ঘুরতে চাইলে

বাসের রুট আর কত নম্বর বাস যাবে- এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়লাম। একটা বুঝছি তো আরেকটা বুঝছি না! বইমেলায় দেওয়া বইয়ের ফর্দের মত বাসরুটের বইটা। এক বৃদ্ধকে কাগজটা দেখালাম। উনি বললেন, ‘আমি প্রায় বারো বছর ধরে বাস ব্যবহার করছি না।’ তবে পড়ে বোঝার অনেক চেষ্টা করলেন। এরপর ওখানকার এক সরকারি কর্মকর্তাকে দেখালেন, উনিও বুঝতে পারলেন না। তখন দু’জনে পরামর্শ দিলেন, তুমি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে অপেক্ষা কর। একঘণ্টা পর পর বাস যাতায়াত করে, পেয়ে যাবে।

Advertisement

আমিও খুব একটা চিন্তা না করে বেরিয়ে পড়লাম কিন্তুু বাইরে তো জমপেশ ঠান্ডা! বেরিয়ে প্রথমে চিন্তা করলাম ফিরে যাবো কিনা? নিরুপায়! বাসের সময়সূচি তো জানি না! এখানে অপেক্ষা করতে থাকলে বাস যদি চলে যায়, তা-ও আবার চোখের সামনে দিয়েই! দূর থেকে দেখা যাবে, দৌড়ে গিয়ে থামানো সম্ভব না কোনভাবেই! তাই যত ঠান্ডাই হোক ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করা উচিত। বরফের পিচ্ছিল রাস্তা পেরিয়ে সাবধানে এগোলাম। যে জায়গাগুলোতে বরফ জমেছে, ওগুলো কাচের ন্যায় স্বচ্ছ না বরং বালির মত হাতে নিয়ে বরফের গোলা বানানো যাবে। ওই রাস্তা ধরেই হাঁটছি। নচেৎ ধপাস! আকাশ-পাতাল মুহূর্তের মধ্যেই এক হয়ে জানান দেবে, ‘বৎস, সামলে!’

রাস্তা পেরোতে গিয়ে পড়লাম আরেক ঝামেলায়, কোন দিকে যাব? এখানকার রাস্তায় নির্দিষ্ট জায়গায় ছবি সম্বলিত দিক নির্দেশক বসানো থাকে। ওদিকেই পারাপার। এখানে তো এরকম কিছুই দেখছি না। অগত্যা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম রাস্তার মাথায় গিয়ে। দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটছে। রাস্তা অত চওড়া বলা যাবে না। আমি রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুুুতি নিচ্ছি। মূল রাস্তার কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই সব গাড়ি আপনা আপনি দাঁড়িয়ে গেল! এ এক আজব দৃশ্য! ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের দেশের বেপরোয়া বাসগুলোর কথা মনে পড়লে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না!

> আরও পড়ুন- বিদেশের মাটিতে বিড়াল বিভ্রাট!

Advertisement

এখানে একজন পথচারীর ক্ষমতা গাড়ির মালিকের চেয়েও অনেক বেশি! কারণ একটাই- আইন! নির্বিঘ্নে রাস্তা পেরিয়ে গেলাম। শুরু হলো অপেক্ষা। কতক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে? কনকনে ঠান্ডায় ঠনঠন করে কাঁপছি! পা দু’খানা তো আগেই জমে গিয়েছিল, এখন হাতও জমে গেছে। এরপর নাক আর কপালও জমছে! চিন্তা করতে লাগলাম, এত বরফ আসে কিভাবে? সবখানেই শুধু বরফ। বিগত দিনগুলোর সেই শুভ্রতার সুখস্মৃতি এখন ক্রমশ বেদনার্ত করে তুলছে আমাকে! মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘হে মহাদেব! তুমি তো কৈলাশে থাকো, তোমার তো শীতের বালাই নাই! আমার তো আছে! কিছু একটা করো!’

উমাপতি সারা দিলেন! দশ মিনিটের মধ্যেই বাস এলো। উঠে টিকিট বাক্সে ফেললাম আর বললাম, ‘আমাকে ইউনিভার্সিটি নামিয়ে দেবেন, আমি রাস্তা চিনি না!’ তখন ড্রাইভার আমাকে আরেকটা হলুদ রঙের কাগজ দিলো। এখানকার নিয়ম হচ্ছে- যে বাসে যাত্রী টিকিট জমা দিলো, সেই বাস যদি গন্তব্যস্থলে না যায়- যাত্রীকে যদি বাস পরিবর্তন করতে হয়; তখন ওই বাসের ড্রাইভার এই কাগজটা দেবেন। পরের বাসে উঠে ওটা একটা পকেটে ফেলে দিতে হয়। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে!

উঠে বসতেই এক দীর্ঘকায় বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম। দেখতেই আমাকে বললেন, ‘হাই বাডি! হাউ আর ইউ?’ আমি অনেক সমস্যায় জর্জরিত এবং শীতের প্রতাপে কম্পমান হওয়া সত্ত্বেও হাসিমুখে বললাম, ‘আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?’ এখানে আবার সবাই সবাইকে নাম ধরেই ডাকে। আমরা সামনেই বসা ছিলাম। একটা জায়গায় বাস এসে থামলে ড্রাইভার নিজেই ওই বৃদ্ধকে বলল, ‘এই ছেলেকে ইউনিভার্সিটি একটু চিনিয়ে দিলে ভালো হতো।’ বৃদ্ধ সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমিও ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি!’ কারণ জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘আমার বয়স ৭৬ বছর। আমি এই ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ছাত্র!’ এরপর বললেন, ‘জ্ঞানার্জনের পথ কখনো বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত না।’ তিনি আমার দেশ, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, আবহাওয়া- সবকিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। বেশ খোশ মেজাজেই হেসে হেসে গল্প চলতে লাগলো। মনে হলো আমি ওনার নাতি! অনেকদিন পর নাতির দেখা পেয়ে তার আনন্দের সীমা নেই!

> আরও পড়ুন- কানাডার বুকে ভাত আর আলুভাজি!

Advertisement

পৌঁছে গেলাম ভার্সিটি। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সেন্টারে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। দেখলাম ডানিয়েল তখনো অফিসে বসে, কাজে ব্যস্ত। আমাকে দেখতেই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আইডি কার্ডের ফটোকপি করলো, বাকি কাগজপত্র আগেই প্রস্তুুত করে রাখা ছিল। সবগুলো আবার দেখলো, আমাকেও দিলো। খামে নিলো, কাজ আপাতত শেষ। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ওরাই পাঠানোর ব্যবস্থা করবে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। এটা কানাডা পোস্টের (সরকারি ডাক) মাধ্যমে পাঠাতে হবে। আমাকে দেখিয়ে দিলো কিন্তুুু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরের বাস ক’টায় আসবে, সেটাও ওকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম। ডানিয়েলের অফিসের সময় শেষ, ও চলে গেল। ও ভেবেছিল আমি ওই বইটা (বাসের সময়সূচি) বুঝতে পেরেছি।

আটকে পড়লাম ইউনিভার্সিটিতে। বুঝতে পারছি না কিছু। মারসিয়াকে হোয়াটস অ্যাপে ফোন করতে লাগলাম, কোন সাড়া পেলাম না। এখন ট্যাক্সিও ডাকতে পারছি না। ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে। কাছেই বুক স্টোর ছিল, সেখানে গেলাম। বললাম, ‘আমাকে একটু সাহায্য করুন। কেউ একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে পারেন!’ ওরা আমাকে ক্যাপারস কনভেনিয়েন্স দেখিয়ে দিলো। গেলাম, এক সুন্দরী চাইনিজ তরুণী বসে আছে। ওকে একইভাবে অনুরোধ করলাম। সাথে সাথেই ফোন বের করে বলল, ‘সিওর!’ আমার প্রাণে পানি এলো! যেন ধূ-ধূ মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত পথিক জলের সন্ধান পেয়েছে। মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নম্বর প্লিজ!’ নম্বর নিয়ে ডায়াল করলো। এরপর আমাকে দিয়ে দিলো। আমি ইউনিভার্সিটিতে আসতে বললাম। তরুণীকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে যে রাস্তাটা ডানিয়েল দেখিয়ে দিয়েছিল সেদিকে চলে গেলাম। ট্যাক্সি এলো, ঠিকানা বলে সিট বেল্ট লাগিয়ে বসে পড়লাম। দশ-বারো মিনিট লাগে পৌঁছতে। ভাড়া এলো এগারো ডলার। মানে বাংলাদেশি টাকায় ৭০৪.১৯ টাকা!

অবশেষে বাসায় পৌঁছলাম। কাল থেকে ক্লাস শুরু। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কী খাবো? প্রথমে জুতোটা ছেড়ে নিই। যে ভারি, মনে হয় পায়ে লোহার বেড়ি পরেছি! বাসমতি চাল, বাংলাদেশে থাকতে খুব একটা খাইনি। এখানে কী খাবো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

> আরও পড়ুন- ঘন জঙ্গলে নেকড়ে বাঘের ডাক

ওয়ালমার্টে গিয়ে চালের যে প্যাকেটটা পছন্দ হয়েছে, ওটাই নিয়ে এসেছি। বসিয়ে দিলাম চাল। সাথে আর কী খাওয়া যায়? আলু ভাজি! সবজি কাটা আসলেই কঠিন কাজ, মা সবসময়ই বলতেন! রান্না করার চাইতেও সবজি কাটাটাই বেশি সময় নিয়ে নেয়। মিষ্টি পেটিস খেয়ে নিলাম স্রেফ জল দিয়ে, চা পাব কোথায়? আর বানিয়ে দেবেই বা কে? কোনমতে ভাতটা সেদ্ধ হতে দিয়ে আলুভাজিটা সেরে নিলাম। প্রথমবার বলে তেল একটু বেশিই হয়ে গেল। পেটপুজো সেরেই শুতে চলে যাচ্ছিলাম, মারসিয়া ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘কিছু কথা ছিল। আমার এখানে আরেক ছাত্র আসছে। ও উপরের ঘরেই থাকবে, তোমরা একই কোর্সের! ওর নাম জগজিৎ, ভারতীয়, পাঞ্জাব থেকে!

চলবে...

এসইউ/এমএস