৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি প্রধান অংশকে চিরতরে মুছে দেবার অপচেষ্টা। ভাবতে অবাক লাগে, যে খন্দকার মোশতাক এক সময় এই চারজন নেতার সতীর্থ ছিলেন- তার যোগসাজশেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়!
Advertisement
১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করার পর থেমে থাকেনি ঘাতকচক্র। তারা চেয়েছে, যে কোনো ভাবেই শেখ মুজিবের আদর্শ মুছে দিতে। যে চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিলেন মহান মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম সংগঠক। মনে পড়ছে, আমি নিউইয়র্কে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি জেলহত্যার রাতের রোমহর্ষক ঘটনা আমাকে বলেছিলেন।
মূলত সেই রাতে আব্দুস সামাদ আজাদকেও হত্যা করার কথা ছিল। তিনি সেই সময় টয়লেটে ছিলেন। ঘাতকদের মিশনটি এতো দ্রুত সম্পন্ন হয়েছিল, তিনি সেখানে নিশ্চুপ বসে থেকেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী জাতীয় চারনেতা- স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী দখলদার চক্রান্তকারী অশুভ রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায় কিছু সেনাসদস্য রাষ্ট্রের সুরক্ষিত স্থান হিসেবে বিবেচিত কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় তার অবর্তমানে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার সুপরিকল্পিত ও সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।
Advertisement
খন্দকার মোশতাক আহমদ ছিলেন মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেইড এজেন্ট। স্বাধীন বাংলাদেশ যদি হয়েও যায়, তাতে যাতে পাক-মার্কিন তমদ্দুনের 'নেতৃত্ব' থাকে সেই চেষ্টা মার্কিনিরা করে আসছিল ষাটের দশক থেকেই। সেখানে খন্দকার মোশতাক ছিলেন তাদের ফার্স্ট চয়েস।
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের সময়ে মূলত পর্যবেক্ষক হিসেবেই মোশতাক, আওয়ামী নেতৃত্বের সাথে মিশে যান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এতই উদারচিত্ত ছিলেন, তিনি মোশতাককে 'চাঁই' হিসেবেই বিবেচনা করেছিলেন। অন্য কথায়, তাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়েই স্বাধীনতা এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।
১৯৭১ থেকে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত খন্দকার মোশতাকের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করলে অনেক কথাই দেখা যায়-যা মূলত ছিল মুজিবের চেতনার বিরুদ্ধে। আমাদের মনে আছে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট খুনি চক্রের পক্ষে মেজর শরিফুল হক ডালিম বেতার ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পাল্টিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো দ্রুততার সঙ্গে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে’ স্বীকৃতি দেন এবং সৌদি আরবসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছেও পাকিস্তানকে অনুসরণের আবেদন জানান।
এটা ছিল খন্দকার মোশাতাকেরই পরিকল্পনা। পঁচাত্তরের ২২ আগস্ট সিআইএর এক প্রতিবেদন বলা হয়েছিল, ‘ভারত সীমান্ত সিল করেছে এবং সন্নিহিত এলাকায় পুলিশ ও সেনা ইউনিট মোতায়েন করেছে। কিন্তু ভারতে মার্কিন কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, এ পদক্ষেপ শুধুই সম্ভাব্য কোনো আকস্মিক অবস্থা মোকাবিলার জন্য। বাংলাদেশের হিন্দুরা ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে শঙ্কিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারে। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি সামলাতেই ভারতের ওই পদক্ষেপ।'
Advertisement
আরও বলা হয়েছিল-‘ভারতীয়রা সম্ভবত বাংলাদেশে তেমন মাত্রায় অস্থিতিশীলতা না ঘটলে কিংবা নতুন সরকার কঠোরভাবে ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ না করলে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। মোশতাককে ভারতের প্রতি কিছুটা শীতল হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব আবার ফিরে এসেছিল। কিন্তু নতুন সরকার তার সীমান্তবর্তী বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশিকে বিরক্ত না করার নীতি গ্রহণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশকে প্রাথমিকভাবে “ইসলামি প্রজাতন্ত্র” করার উদ্যোগ নিয়েও তারা সেখান থেকে সরে এসেছে।’
পঁচাত্তরের ৫ সেপ্টেম্বর সিআইএর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, 'মোশতাক ও তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতাদানকারী সামরিক কর্মকর্তারা অবগত রয়েছেন যে, ভারতের শুভেচ্ছা তাঁদের দরকার এবং তাঁরা সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ঢাকা বুঝতে পেরেছে যে, প্রধানমন্ত্রী গান্ধী যদি সিদ্ধান্ত নেন যে, বাংলাদেশে একটি সেনা হস্তক্ষেপ ভারতীয় স্বার্থের জন্য দরকার, তাহলে ভারত এখনো সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশ এটাও অবগত যে, নয়াদিল্লির প্রতি কম অনুকূল নীতি গ্রহণের ফলে ভারত তাদের সন্দেহের চোখে দেখবে। ভারতের কথা মনে রেখেই ঢাকার সরকার বাংলাদেশকে একটি 'ইসলামি প্রজাতন্ত্র' ঘোষণা করা থেকে বিরত থেকেছে। এর পর পরই মোশতাক প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর কাছে বন্ধুত্বপূর্ণ ও আশ্বাসসূচক বার্তা পাঠিয়েছেন। ভারতকে নির্দিষ্টভাবে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে, দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান মৈত্রী চুক্তি এখনো দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। ভারতীয়রা তাদের পক্ষ থেকে নতুন সরকারের পদক্ষেপগুলো ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করে চলবে। তবে বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে ভারত সচেষ্ট থাকবে।' এসব ঘটনা ছিল মুজিব হত্যার জের কাটিয়ে উঠার পরিকপল্পনা। কিন্তু তাদের ছক ছিল দীর্ঘমেয়াদী।
প্রকাশিত নথিগুলো বলছে- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে স্টাফ সভায় বসেন। ঢাকার খবর জানার জন্য উদগ্রীব কিসিঞ্জার বৈঠকের শুরুতেই বলেন, ‘আমরা এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলবো।’ নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ আলফ্রেড আথারটন সভায় বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে বলেন, ‘এটা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান।’
কিসিঞ্জার জানতে চান, ‘মুজিবুর কি জীবিত না মৃত?’ আথারটন বলেন, ‘মুজিব মৃত। তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠসহ পরিবারের সদস্য, ভাই, ভাগ্নে নিহত হয়েছেন।’ কিসিঞ্জার এই সভায় বসার আগেও ঐদিনের ঘটনাবলী সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমি ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ (আইএনআর) থেকে আরো ভালো খবর পেয়েছি।'
ব্যুরো পরিচালক উইলিয়াম জি হিল্যান্ড কিসিঞ্জারকে জানান, ‘আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলেছি, তখনো শেখ মুজিব নিহত হননি।’ কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা? তারা কি কিছু সময় পর তাকে হত্যা করেছে?’ এর জবাবে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন বলেন, “আমরা যতদূর জানি- আমি বলতে পারি না যে, আমরা বিস্তারিত সবকিছু জেনে গেছি। কিন্তু ইঙ্গিত ছিল তাঁকে হত্যা-পরিকল্পনা বিষয়েই। তারা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে। ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাঁকে হত্যা করে।”
ওয়াশিংটন সময় সকাল আটটায় বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে স্টাফ সভায় মিলিত হওয়া এবং তারও আগে মুজিব হত্যা সম্পর্কে আথারটনের সাথে কিসিঞ্জিারের তৎপরতা থেকে বুঝা যায় তাদের এজেন্টরা আগে থেকেই ঢাকায় তৎপর ছিল। আমরা জানি, হেনরি কিসিঞ্জারচক্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
জেলহত্যা ছিল একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ। আমাদের মনে আছে,৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেয়া তো দূরের কথা, আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। খুনিদের বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশে নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা করেছিল। কাউকে কাউকে মর্যাদাপূর্ণ চাকরি দিয়েও পুরস্কৃত করেছিল পরবর্তী সরকারগুলো। হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বিচারকাজ শুরু করে।
পরবর্তী সময় বিচারকাজ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। ২৯ বছর পর ২০০৪-এর ২০ অক্টোবর অভিযুক্তদের মধ্যে পলাতক ৩ জনের ফাঁসি, জেলে অবস্থানরত ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জামিনে মুক্তদের নির্দোষ ঘোষণা করে বিচারিক আদালত দায়সারা একটি রায় দেয়। রায়ে এত বড় একটি ঘটনায় ষড়যন্ত্রীদের শাস্তির আওতায় না আসাও জাতিকে বিস্মিত করে। পরে ডেথ রেফারেন্স ও রায়ের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষের করা আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত দুই আসামিকে বেকসুর খালাস এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্তদের মধ্যে চারজনকে দণ্ড থেকে অব্যাহতি দেন।
এসব ঘটনা মূলত গোটা জাতিকে থমকে দিয়েছে। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও পুনর্বিচার দাবি করেছিলেন। এ ছাড়া জেলহত্যা মামলায় যথাযথ তদন্ত হয়নি বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। বর্তমান প্রজন্মকেও বিভিন্ন সময়ে এই হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও জেল হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। কেন হয়নি ? এই প্রশ্ন দেশের আপামর মানুষের।
জাতীয় চার নেতার প্রতি আমাদের ঋণ শেষ হবার নয়। তাঁদের ত্যাগ ছড়িয়ে দিতে হবে এই প্রজন্মের মাঝে। জেল হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে দেশি যেসব হায়েনা যুক্ত ছিল, তাদের কেউ কেউ এখনও ফণা দেখাচ্ছে নানা ভাবে। তা সবাইকে মনে রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, খুনিরা সবসময়ই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সুযোগ পেলেই ছোবল দেয়।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস