আনুষ্ঠানিকভাবে টাইগারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যাত্রা শুরু ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপ থেকে। প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে স্কটল্যান্ডের পর পাকিস্তানকে হারায় বাংলাদেশ। বলা বাহুল্য টেস্ট ক্রিকেটের দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম শিকার পাকিস্তান। এরপর টেস্ট ক্রিকেটের সবগুলো দলকে হারাতে টাইগারদের লেগে যায় আরও ১১ বছর। প্রথম পর্বের মিশনে শেষ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইংল্যান্ড। ২০১০ সালে ব্রিস্টলে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বৃত্তপূরণ করে বাংলাদেশ। এরপর থেকে চলছে দ্বিতীয় পর্বের মিশন। এই মিশনে ৫ বছরের মধ্যেই শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে টাইগাররা। দ্বিতীয় পর্বের বৃত্তপূরণে এখন শেষ বাধা অস্ট্রেলিয়া।প্রথম পর্বের সঙ্গে টাইগারদের দ্বিতীয় পর্ব মিশনের পার্থক্যটি খুবই মৌলিক। প্রথম পর্বের জয়গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবেই দেখেছে সবাই। স্বভাবতই ক্রিকেটের নতুন শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার স্বীকৃতি মেলেনি। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রিকেটে নতুন শক্তির সব লক্ষণগুলো নিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলো ছড়াচ্ছে বাংলাদেশ। ধরা যাক ইংল্যান্ডের কথাই। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ইংল্যান্ডকে হারাতে লেগেছে এক দশক সময়। ইংলিশ জুজু এখন সুদূর অতীত। সর্বশেষ দুটো বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ডকে মাটিতে নামিয়েছে টাইগাররা। এবারের বিশ্বকাপে ডু অর ডাই’ ম্যাচে ইংলিশদের হারিয়েই নক আউট পর্বের ছাড়পত্র আদায় করে নেয় বাংলাদেশ। এই হারে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় ইংলিশদের।দ্বিতীয় পর্ব মিশনে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা হয়েছিল পাকিস্তান। ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপ থেকে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় জয় পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৬ বছর। আরও সহজ করে বললে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর পাকিস্তানকে হারাতে সময় লেগেছে দেড় দশক। পাকিস্তান দুঃস্বপ্ন এখন পুরোটাই সুখস্মৃতি। সর্বশেষ তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডুবিয়েছে বাংলাদেশ। জয় এসেছে টি২০ ম্যাচেও। একটি টেস্ট হারলেও আরেকটি টেস্টে ড্র করেছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের আগে বাংলাদেশকে ফেভারিট ঘোষণা দিয়েছিলেন বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এই বিশ্বাসের জোরটাই দ্বিতীয় পর্বের বাংলাদেশ।দ্বিতীয় পর্ব মিশনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা একের পর এক সিরিজ জয়। বেশ কিছুদিন ধরেই জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্টইন্ডিজ কিংবা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিয়মিতভাবেই সিরিজ জিতে আসছে বাংলাদেশ। তবে ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর বিপক্ষে সিরিজ জিততে না পারলে সাফল্য ঠিক পরিপূর্ণতা পায় না। বিশ্ব সেরাদের কাঁতারে নিজেদের দেখতে চাইলে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে বড় দলগুলোর বিপক্ষে বড় সাফল্য তাই পরিণত হয় সময়ের দাবিতে। এ বছরে সেই দাবিই একের পর এক পূরণ করে চলেছে বাংলাদেশ। উপমহাদেশের মাটিতে ভারতকে হারানো ক্রিকেটের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আর তাই পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের আগে নিজেদের ফেভারিট দাবি করলেও ভারতের বিপক্ষে সিরিজের আগে যথষ্টিই সতর্কতা অবলম্বন করে বাংলাদেশ শিবির। ভারতের বিপক্ষে পরপর দু ম্যাচ জিতে এক ম্যাচ হাতে রেখেই তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজ নিজেদের করে নেয় টাইগাররা। ধোনি বাহিনির এই পরাজয়কে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উথ্বান হিসাবে উল্লেখ করেছেন ভারতীয় গ্রেটরা। ভারতের শীর্ষ মিডিয়াগুলো জুড়েই বাংলাদেশের জয়জয়কার।বিশ্ব ক্রিকেটে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসাবে ধরা হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। হোম -অ্যাওয়ে সবখানেই সমানভাবে সফল দলটি। উপমহাদেশে প্রোটিয়াদের রেকর্ড এক কথায় ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ সফরের আগে উপমহাদেশের তিন প্রধান ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে সর্বশেষ তিনটি ওয়ানডে সিরিজেই হারিয়েছে প্রোটিয়ারা। আর টেস্ট ক্রিকেটে উপমহাদেশের মাটিতে গত ১১ বছর ধরে দলটি অজেয়। স্বভাবতই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজটি বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় প্রমাণের চ্যালেঞ্জ। টি২০ সিরিজের পর তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে প্রথম ম্যাচটিও জিতল প্রোটিয়ারা। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকা একবার এগিয়ে গেলে সেই সিরিজে ফেরাটা যে প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার সেটা অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই বলা যায় প্রায় অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে টাইগাররা। পরপর দু ম্যাচ জিতে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। আর এর মধ্য দিয়ে যে কোনো দলকেই হারানো সম্ভব- এমন সত্যটাই প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে টাইগাররা।টেস্ট ক্রিকেটের দলগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সিরিজে হারাতে পারেনি ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা আর অস্ট্রেলিয়াকে। তবে এই জায়গাটিতে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান একটু ভিন্ন। কেননা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র জয়টি ১০ বছর আগের। আর সেখানে সর্বশেষ তিন ম্যাচের দুটিতেই ইংল্যান্ডকে হারানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ দু`টো বিশ্বকাপে হারানো ছাড়াও স্বাগতিক ইংলিশদের হারানোর গৌরবের অধিকারীও টাইগাররা। সিরিজে না জিতলেও লঙ্কানদের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ নিয়মিতভাবেই জিতছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে ১-১ সমতায় থেকে ওয়ানডে সিরিজ শেষ করেছে টাইগাররা।সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে বড় দলগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই যেন অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনি বাস্তবতায় আগামী মাসে বাংলাদেশ সফরে আসছে অস্ট্রেলিয়া। এই সফরে শুধু টেস্ট খেলবে বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। এদিকে তিন ফর্ম্যাটের ক্রিকেটের ভেতরেও বাংলাদেশের সেরা পারফরম্যান্স ওয়ানডে ক্রিকেটে। আর তাই ওয়ানডে সিরিজ না হওয়া মানে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ অনেকটাই কমে যাওয়া। আসন্ন সিরিজে চ্যালেঞ্জটা আরও বড়। আর মজাটা ঠিক এখানেই। টেস্ট ক্রিকেটে প্রমাণের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সেরা সুযোগ এবার বাংলাদেশের সামনে।টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ যে অনুজ্জল সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সম্ভাবনার বাইরে রাখাটাই বা কতখানি যুক্তিসঙ্গত? টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরেই র্যাংঙ্কিংয়ে এক নম্বর জায়গাটি দক্ষিণ আফ্রিকার। এ নাম্বার ওয়ানদের বিপক্ষে মাত্র কদিন আগেই কি ঔজ্জল্য ছড়ায়নি টাইগাররা? চট্রগ্রাম টেস্টে প্রথম ইনিংসে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ৭৮ রানের লিডও নেয় স্বাগতিক বাংলাদেশ। বৃষ্টিতে দুটো টেস্টই ভেসে যাওয়াতে হয়ত নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণটা সেভাবে রাখার সুযোগ পায়নি টাইগাররা। মনে রাখতে হবে দুবছর আগে শ্রীলঙ্কার মাটি থেকে একটি টেস্ট ড্র করতে সমর্থ হয়েছিল বাংলাদেশ। আর সব কথার এক কথা হালের অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট রেকর্ড যথেষ্টই বিবর্ণ। ইংল্যান্ডের কাছে অ্যাশেজে হারের দুঃস্মৃতি নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছে দলটি। এছাড়াও বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ০-২ ব্যবধানে নাকাল হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আর তাই টেস্ট ক্রিকেটে প্রমাণের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের শেষ বাধা পেরুনোর সুযোগ এখন টাইগারদের সামনে।এইচআর/পিআর
Advertisement