মতামত

হাসিনা-কামাল সংলাপ : রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস রচনার প্রয়াস

বাংলাদেশে যখন কিছু ঘটে তখন তা এতো দ্রুত ঘটে যে, এসব ঘটনার সঙ্গে তাল মেলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। আজকের দিনটির (২৯ অক্টোবর, সোমবার, ২০১৮) কথাই ধরা যাক। বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে মামলা চালানোর পক্ষে উচ্চ আদালতের রায় ঘোষিত হলো বেশ সকালেই। আর দিনের মধ্যভাগের একটু পরেই ঘোষিত হলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায়, যাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ৭ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হলো।

Advertisement

তার কিছুক্ষণ পরেই নির্বাচন কমিশন থেকে গেজেট প্রকাশিত হলো জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের । আর দিনশেষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা এলো দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকে। উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি একটি ‘প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ’ দিলেন এবং জানালেন যে, নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংলাপে বসতে সম্মত এবং একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে যে সব সময় দরোজা খোলা থাকে সেকথাটি ওবায়দুল কাদের জানালেন সকলকে।

এমনিতে দেশব্যাপী চলছে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট। পথে পথে গাড়ির চালক ও যাত্রীদের মুখে যখন পোড়া মোবিল লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন একই দিনে এতোগুলো রাজনৈতিক-ঘটনা সাধারণ জনগণের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই অন্যায় আচরণকে একটু পেছনে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। একটি দেশের ভেতর দাবি আদায়ের নামে এরকম নৈরাজ্যকে প্রশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে তা দৈত্যের রূপ নেবে, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে এই ভয়ঙ্কর দানব দমনে।

ফিরে আসি দেশের চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে। নিঃসন্দেহে আজ থেকে সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে সংলাপ সম্পর্কিত অগ্রগতি। এখানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে একটি ধন্যবাদ দিতেই হয় এবং দল হিসেবে আরো একবার আওয়ামী লীগ প্রমাণ করলো যে, দলটি আসলে এদেশের রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থেই একটি উদার গণতান্ত্রিক পক্ষকে নেতৃত্ব দেয়। ২০১৩ সালের শেষ দিকে যদি ফিরে যাই আমরা তাহলে দেখতে পাই যে, দেশ যখন একটি ভয়ঙ্কর দুঃসময় পার করছিলো তখন নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন।

Advertisement

সেই ফোনালাপের একটি অডিও প্রকাশিত হয়েছিল এবং আমরা জেনেছিলাম যে, বেগম জিয়া অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি তারও পরে শেখ হাসিনা নিজে গিয়েছিলেন বেগম জিয়ার দরোজায়, কিন্তু সে দরোজা খোলেনি। এতে জনমনে বিএনপি-রাজনীতির ইতিবাচক নাম্বার যোগ হয়নি, বরং বিএনপি’র সমর্থকদের মধ্যেও বিষয়টি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।

দীর্ঘ ১০ বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দলটির দুই প্রধান নেতৃত্ব বেগম জিয়া ও তারেক জিয়া, দু’জনেই আদালতের রায়ে দণ্ডিত অপরাধী। বিএনপি যতোই বলুক যে, আদালতের এই রায় তারা মানে না তাতে অবস্থার হেরফের খুউব একটা হবে বলে মনে হয় না। আর সে কারণেই দলটির বুদ্ধিমান দ্বিতীয় সারির নেতারা ড. কামালের মতো এমন একজন ব্যক্তিকে নেতা মেনে একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন, যাতে রাজনীতিতে দলটিকে টিকিয়ে রাখা যায়।

সেটি যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা কোনো ভাবেই ভুল করেননি, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো কারণ ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিত্বের পাঠানো চিঠির জন্যই শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন- এটা বোঝার জন্য অনেক বেশি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকার দরকার নেই। এবং এটাই সত্য যে, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যদি বাংলাদেশে একটি নতুন ও গণতন্ত্রমনা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানা রাজনৈতিক পক্ষের জন্ম হয় তাহলে তা হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।

এতোদিন যারা দাবি করে আসছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ আর মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী থাকবেন না এবং বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মেনে তবেই এদেশে রাজনীতি করতে হবে তারা হয়তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করা ড. কামাল হোসেনকে ত্রাতা ভাবছেন। কারণ, বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী-বিরোধিতার নামে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু-বিরোধিতার রাজনীতি করে আসছিলো।

Advertisement

এমনকি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে খোদ বিএনপি নেত্রীর বক্তব্য এবং ১৫ই আগস্টে বিএনপি-নেত্রীর ঢাউস কেক্ কেটে উদযাপন করাকে কোনো পক্ষই ভালোভাবে নেয়নি, নিতে পারে না, নিতান্তই মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী রাজাকার এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি না হলে। এখন সেই দলটিকেই যদি অতীতের এই ক্ষমার অযোগ্য দায় থেকে বের করে এনে ড. কামাল হোসেন একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ধারায় নিয়ে আসতে পারেন তাহলে তা হবে দেশের জন্য মঙ্গলজনক, গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক এবং দেশের উন্নয়নের গতিধারায় নতুন সংযোজন।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ বার বারই প্রমাণ করছে যে, তারা রাজনৈতিক ভাবে কোনো প্রতিপক্ষকেই আসলে ভয় করে না এবং তারা যে কোনো বিষয় নিয়েই সংলাপেও পিছপা নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি যে, দুই প্রধান দলের সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে সংলাপ হয়েওছিল কিন্তু তার কোনো সুনির্দিষ্ট ফলাফল আমরা দেখতে পাইনি। এবার আর সাধারণ সম্পাদক নয়, এবার আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতৃত্ব ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।

তার মানে এই সংলাপ থেকে ইতিবাচক কোনো ফলাফল আসার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় যে কাজটি হয়েছে তাহলো, এই দু’দিন আগেও ঐক্যফ্রন্টের নেতারা চট্টগ্রাম থেকে যে সকল হুমকি-ধামকি দিচ্ছিলেন যে, ১০ দিনের মধ্যেই সরকারকে একটা মহা শিক্ষা দিয়ে দেওয়া হবে এবং অনেকের মনেই এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, বেগম জিয়ার মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার পর দেশব্যাপী নতুন নাশকতার ঘটনা ঘটবে- এসব ভয়ঙ্কর অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মুখে একেবারে পানি ছুঁড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগের এই সংলাপের প্রস্তাব।

এর পরও যদি দেশে কোনো নাশকতার ঘটনা ঘটানো হয় তাহলে নিঃসন্দেহে সংলাপ প্রক্রিয়া ভেস্তে যাবে এবং আসন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়ায়ও তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। সে কারণেই বিএনপি’র উচিত অবিলম্বে দলটির সাধারণ নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া যাতে তারা কোনো ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত কোনো ঘটনায় না জড়ায়।

সবকিছুর পরেও একথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, এমন একটি সময়ে যুযুধান দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যখন দেশের ভেতরে ও বাইরে আগামি দুই মাসের রাজনীতি নিয়ে একটি নেতিবাচক সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। আলোচনার ফলাফল যাই-ই হোক না কেন, আমি নিশ্চিত যে, এর ফলে রাজনীতি থেকে সহিংসতা একটু হলেও দূরে সরে গেলো এবং দেশের মানুষ শঙ্কামুক্ত হলো।

এই মুক্তি সাময়িক যাতে না হয় তার জন্য দু’পক্ষকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছাড় দিতে হবে, নাহলে আবারও যদি সংলাপের ফলাফল অশ্বডিম্ব হয় তাহলে রাজনীতির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকটও তৈরি হবে। তবে এরকম নেতিবাচক চিন্তা এখনই স্থান দিতে চাই না, বরং আশাবাদী হতে চাই যে, ড. কামাল হোসেন ও শেখ হাসিনার মতো দু’জন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিতে এই দু’জন মানুষই চাইলে পারবেন একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম দিতে। আমরা বরং, সেই স্বপ্ন নিয়েই সংলাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই।

ঢাকা ২৯ অক্টোবর, সোমবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/পিআর