গত ২৬ অক্টোবর শুক্রবার নিউইয়র্কের পত্রিকায় (সাপ্তাহিক আজকাল) একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদের শিরোনাম-- “তল্লাশির সময় পুলিশকে পরিচয় দিতে হবে : নিউইয়র্ক সিটিতে ‘রাইট টু নো’ আইন কার্যকর।” কয়েকদিন আগে ঢাকার রাস্তায় তল্লাশির নামে পুলিশ কর্তৃক এক নারীকে ‘উত্ত্যক্ত’ করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে লেখালেখিও কম হয়নি। ওই ঘটনা নিয়ে পরে বলছি। এখন খুব প্রাসঙ্গিকভাবে আপনাদেরকে নিউইয়র্ক পুলিশের একটি নতুন আইন সম্পর্কে জানাতে চাই। এ সপ্তাহেই আইনটি কার্যকর হয়েছে।
Advertisement
আজকাল-এর ওই সংবাদে বলা হয়েছে, রাস্তায় কাউকে আটকাতে হলে নিউইয়র্ক পুলিশকে আগে তার নিজের পরিচয় জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের পুরো নাম ও র্যাংক জানাতে হবে এবং বিজনেস কার্ড দেখাতে হবে। নতুন এই আইনের প্রয়োজন অনুযায়ী নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট-এনওয়াইপিডি তাদের ৩৫ হাজার অফিসারের জন্য ১ কোটি বিজনেস কার্ড ছাপিয়েছে। এগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে জানার মতো তথ্য লিখিত আছে। পুলিশ অফিসারদের ব্যক্তিগত নাম-পরিচয়, শিল্ড নম্বর ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া রয়েছে। রাস্তায় তল্লাশি করার সময় পুলিশের তরফ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এই বিজনেস কার্ড দেওয়া বাধ্যতামূলক।
জানুয়ারিতে সিটি কাউন্সিলে পাস হওয়া ‘রাইট টু নো’ আইন অনুযায়ী নিউইয়র্ক পুলিশকে এখন থেকে এই বিধান মেনে চলতে হবে। গত ১৯ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর হয়েছে। এই আইনের বিধান অনুযায়ী রাস্তায় কাউকে তল্লাশি বা আটক করতে হলে পুলিশ অফিসারদের এখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তার পরিচয় সম্পর্কে সবিস্তারে জানাতে হবে এবং বিজনেস কার্ড দিতে হবে। এই বিজনেস কার্ডের পেছনে তথ্য দেয়া আছে কেমন করে একজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা যায়। এমনকি পুলিশের শরীরে (বডি) থাকা ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও কেমন করে দাবি করা যায়, সে সম্পর্কেও তথ্য দেয়া আছে। কোন কোন ধরনের তল্লাশির ব্যাপারে তাদের আপত্তি জানাবার অধিকার আছে সে বিষয়েও পুলিশ কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবহিত করবেন।
এই আইনটি যে নির্বিঘ্নে পাস হয়েছে তা নয়। দীর্ঘ চার বছর ধরে বিতর্ক ও বিরোধিতার পর গত জানুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলে এই আইনটি পাস হয়। মূল বিরোধিতা ছিল নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (এনওয়াইপিডি) থেকে। আইনটি কার্যকর হওয়ার পরও এ নিয়ে বিতর্ক থামেনি। পুলিশ ইউনিয়ন এই আইনের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলেছে, অপরাধ দমনের কাজে এই আইন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিরুৎসাহিত করবে।
Advertisement
পেট্রোলম্যানস বেনেভোলেন্ট এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট প্যাট লিন্চ বলেছেন, সিটি কাউন্সিল ক্রমাগত আমাদের পুলিশ অফিসারদের ওপর নতুন নতুন বোঝা চাপাচ্ছে যেগুলো অনাকাঙ্খিতভাবে অফিসারদের দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহিত করে তুলছে। এর ফলে নিউইয়র্ক সিটি আরও বিপদজনক নগরীতে পরিণত হতে পারে বলেও প্যাট লিন্চ তার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
তবে বিরোধিতা থাকলেও আইনটি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ এটি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। তারা কমিউনিটি এডভোকেসি গ্রুপগুলোর সাথে একাধিক বৈঠক করেছে এবং তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেছে। এনওয়াইপিডি এ সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলেছে, পুলিশ বিভাগের নীতি নির্ধারণ, প্রশিক্ষণ, আইন প্রয়োগ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য এডভোকেসি গ্রগ্রুপগুলোকে বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়েছে। যা আগে কখনও দেওয়া হয়নি। তারা এখন এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ পাবে।
‘রাইট টু নো’ আইনটির সমর্থকরা বলছেন, জনগণের মধ্যে পুলিশ বিভাগের প্রতি আস্থা সৃষ্টি এবং স্বচ্ছতার স্বার্থে আইনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তারা বলেছেন, বহু মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেবহাল নন। বহু মানুষ জানেন না, রাস্তায় পুলিশ আটকালে তাদের কি বলতে হবে বা কি করতে হবে। পুলিশের মুখোমুখি হওয়ার সাথে সাথে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং যথাযথভাবে পুলিশকে মোকাবিলা করতে পারেন না।
এবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘গভীর রাতে ভদ্র ঘরের কোনো মেয়ে বাড়ির বাইরে থাকে না’ এমন কথা আমরা কে না শুনেছি। আমাদের সমাজে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদেরও একথা শুনতে হয়। এমনকি সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকাকেই প্রচলিত সমাজ বাঁকা চোখে দেখে এসেছে।
Advertisement
আমি-আপনি, আমাদের বাবা-মায়েরা, প্রতিবেশিরা মিলে এই ধ্যান-ধারণা ও সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। ঢাকার রাস্তায় নারীকে তল্লাশি করতে চাওয়া পুলিশরাও তা জানেন। তাই সমাজের মোক্ষম এই অস্ত্রটি তারা ওই নারীর ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু দেশের মানুষ রাত আড়াইটায় বাড়ির বাইরে থাকা একাকী একটি মেয়ের বিপক্ষে না গিয়ে তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বরং মানুষ ভর্ৎসনা করেছে পুলিশকে।
ঘটনাটি অবাক বিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করেছি। নিপীড়িত নারীর পক্ষে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত এ সমাজে আমরা প্রত্যক্ষ করি। সর্বশেষ সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন অনেকে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার অনেক উদাহরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও হরহামেশাই দেখতে পাই। ফেসবুক তো এখন আমাদের সমাজেরই ‘দর্পণ’ হয়ে উঠেছে। ধারণা করি, প্রচলিত সমাজের এ অবস্থানের কারণে যে পুলিশ কর্মকর্তাটি জনৈক নারীকে তল্লাশি করার ভিডিওটি ধারণ করেছেন তিনি আরও লক্ষ-কোটি পুরুষের বাহবা প্রত্যাশায়, ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো নারীর কাছে ‘হিরো’ হওয়ার বাসনা থেকে নিজেই সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে তা ‘বুমেরাং’ হয়ে গেছে।
তাহলে কি আমাদের হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে গেল। দেশের সমাজ-ব্যবস্থা কি পাল্টে গেল। উত্তরটি খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, এই ‘বুমেরাং’ হওয়ার মধ্যেই চলমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের নিজস্ব মতামত ও পারিপার্শ্বিক চিত্রটি নিহিত। ধারণা করি, পুলিশী রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে অভিযোগ বাংলাদেশের ওপর তার বিরুদ্ধে মানুষ নিজের অবস্থান তুলে ধরেছে তার পুরুষতান্ত্রিক পশ্চাৎপদ মানসিকতাকে চেপে রেখে।
একটি রাষ্ট্র তার জনগণের কল্যাণে আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনে যদি রাষ্ট্রেরই কোনো অঙ্গ-সংস্থা-পক্ষের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে সংক্ষুব্ধ পক্ষটি তার বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকেও নতুন আইনটি পাস হওয়া ও কার্যকর করা নিয়ে বিরোধিতা ছিল। কিন্তু সিটি কর্তৃপক্ষ তার অধীনস্থ একটি বিভাগের ৩৫ হাজার অফিসারের কথা চিন্তা না করে তাদের বিবেচনায় প্রাধান্য পেয়েছে এ শহরের ৮৬ লাখ মানুষের বৃহত্তর স্বার্থ। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের বিরোধিতা সত্ত্বেও সিটি কাউন্সিল জনগণের স্বার্থে নতুন আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করেছে। নিউইয়র্কের পুলিশও জনগণের কথা চিন্তা করে তা মেনে নিয়েছে।
ঢাকার রাস্তায় তল্লাশির নামে পুলিশের ভূমিকার বিপক্ষে মানুষের অবস্থানের বিষয়টিতেও সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত। এই একটি ঘটনা সরকারকে নানাবিধ সিগন্যাল দেয়। পুলিশকে শক্তিশালী না করে জনগণকে শক্তিশালী করাই তো সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ। আর এতে করেই মানুষের প্রত্যাশার সত্যিকারের একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো। আমার বিশ্বাস, পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরে যেসব অধিকাংশ জনগণের প্রকৃত বন্ধু রয়েছেন তারাও এজন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত আছেন। লেখক: সাংবাদিক, নিউইয়র্ক।
এইচআর/জেআইএম