মতামত

আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলা মায়ের ঢোল

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে আমার প্রথম পদার্পন ১৯৮৮ সালের এপ্রিলে। সেসময়ে ক্যাম্পাসে ‘মুরগি ধরা’ বলে একটা শব্দের প্রচলন ছিল। কালের বিবর্তনে মুরগিরা এখনও ক্যাম্পাসে মুরগি কিনা জানিনা, তবে আমাদের সময়ে সেটাই ছিল ক্যাম্পাসে আমাদের পরিচয়।

Advertisement

প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজ ছিল মুরগিদের ধরে ধরে হোস্টেলে নিজেদের দখল করা সিটগুলোতে তোলা। অনেকটা খোয়াড়ে মুরগি ভরার মত আরকি। মেডিকেলের পরিভাষায় একেই বলা হত মুরগি ধরা। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ সবসময়ই ছাত্রলীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু আমরা যে সময়টায় ক্যাম্পাসে যাই তার কিছুদিন আগেই জেনারেল এরশাদ সাহেব জাতীয় ছাত্র সমাজ বিলুপ্ত করেছেন। ছাত্র সমাজে যোগ দেয়া ক্যাডারদের দিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে জাতীয়াতাবদী ছাত্রদলের তখন রমরমা অবস্থা।

ক্যাম্পাসে আমাদের দ্বিতীয় রাতেই মুরগি ধরা নিয়ে ছাত্রলীগের উপর ছাত্রদলের আক্রমন এবং সঙ্গত কারণেই মেডিক্যাল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। ক’দিন পরে ক্যাম্পাস খুলতেই একই কারণে আবারো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার ক্যাম্পাস খোলার অল্পকদিনের মাথায় ফরেনসিক মেডিসিন ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভা বোর্ডে দুজন অধ্যাপকের সামনে ছাত্রদলের ক্যাডারদের নির্মম ছুরির আঘাতে নিহত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখার সেসময়কার যুগ্ম-সম্পাদক, টগবগে তরুণ ছাত্রনেতা রাইসুল হাসান নোমান।

নোমান ভাইকে ছুরিকাঘাত করে বীরদর্পে ক্যাম্পাস থেকে জাতীয়তাবাদী শ্লোগান দিতে দিতে বের হয়ে যাওয়া ছাত্রদলের সেই মিছিলের প্রত্যক্ষদর্শী আমার মত ক্যাম্পাসে সেদিন উপস্থিত আরো বহুশত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। নোমান ভাইয়ের পেটের মূল ধমনীটি ছুরি দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়া হয়েছিল। পানির মত রক্ত দিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি সেদিন।

Advertisement

নোমান ভাইয়ের রক্ত মাখা, শতছিন্ন অ্যাপ্রন এখনও মাঝে মাঝেই আমার নিদ্রাভঙ্গের কারণ হয়। নোমান ভাইয়ের মৃত্যুর পর যথারীতি একটি মামলা হয়েছিল। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের শাসন আমলে বহু তদন্তের পরও মামলার সব আসামীরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তাদের কেউ কেউ আজ চিকিৎসা পেশায়ও নিয়োজিত। জানিনা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পিতাদের এই কলঙ্কিত অতীত সম্বন্ধে জানে কিনা।

সম্ভবত না। তবে জানি শহীদ নোমান বিচার পাননি। বিচার পাননি নোমান ভাইয়ের পরিবারও। বহু বছরের বিস্মৃতিতে শহীদ রাইসুল হাসান নোমান এখন প্রায় বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম। প্রিয় বন্ধু, একসময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি, এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ডা. একরাম শুধু মনে করে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর নোমান ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে যত্ন করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেয়, আর আমরা দু’চার-পাঁচজন তাতে লাইক আর কমেন্ট দিয়ে দায়িত্ব সারি।

ব্যস এইটুকুই। শহীদ নোমানের নামে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে কোন ভবনের নামকরণ করা হয়নি। সেখানে নেই তার কোন স্মারকস্তম্ভ। বিচারহীনতার বাংলাদেশে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ সম্ভবত যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এই কলঙ্ক তিলকটি মুছে ফেলতে চেয়েছে।

’৭৫ -এর পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে যেদেশে জাতির জনক আর তার পরিবারের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের বদলে বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে, যেদেশে ত্রিশ লক্ষ শহীদের চিহ্নিত খুনিরা রাষ্ট্রীয় মদদে শুধু রাজনীতির অধিকারই নয় বরং গাড়িতে-বাড়িতে জাতীয় পতাকাও পেয়েছে, বিচারহীনতার সেই বাংলাদেশে সামান্য একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের পরিবার তার হত্যাকাণ্ডের বিচার পাবেন এমনটা অবশ্য প্রত্যাশিতও নয়। ‘নোমানদের’ কেউ মনে রাখেনা, রাখার কথাও না।

Advertisement

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের শাসনকাল প্রায় শেষ হতে চললো। সামনে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃতীয় মেয়াদে তার অর্জন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন যে এসময় সারাদেশে, সব সেক্টরে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তা নজিরবিহীন।

সত্যি-ই তাই। বাংলা ডিকশনারিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক নতুন শব্দের জন্ম দিয়েছেন - ডিজিটাল বাংলাদেশ, এলএনজি টার্মিনাল, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, স্যাটেলাইট, বুলেট ট্রেন, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ওয়াইব্রিজ, এমনি আরো কত কি! তার নেতৃত্বের অনন্যতায় বাংলাদেশ আজ কত কিছুতেইতো বিশ্বের রোল মডেল।

কিন্তু আমার কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অন্যতম অবদান বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে পিছনে ফেলে আইনের শাসন আর বিচারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা ফিরিয়ে দেয়া। তার কোন অবদানকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, সেই দুঃসাহসও আমার নেই। তারপরও তার অসংখ্য-অজস্র অর্জনের ভিড়ে তার এই অর্জনটাই আমার কাছে শীর্ষে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শাসন আমলেই বিচার হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের। বিচার হয়নি বিশেষ কোন আদালতে কিংবা বিশেষ কোন আইনেও। বিচার হয়েছে প্রচলিত আদালতে, প্রচলিত আইন মেনেই।

দীর্ঘ, ক্লান্তিকর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আংশিক কার্যকর হয়েছে সেই রায়। কিন্তু জাতির দায়মুক্তি হয়েছে পুরোটাই আর সংবিধান হয়েছে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভারমুক্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছে ব্যাপারটি এভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। বরং একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রী জাতিকে জাতির পিতার হত্যার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এটি একটি অনন্য মাইলফলক।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে এবং এখনও চলমান। এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে শীর্ষ অপরাধীদের অনেক দণ্ডই। আশির দশকের শেষে আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শ্লোগানে-শ্লোগানে কতইতো গলা ফাটিয়েছি এক দড়িতে সাকা-নিজামীর ফাঁসির দাবিতে। বিশ্বাস করুন, কখনোই বিশ্বাস করিনি সেই দিনও দেখার সুযোগ হবে। এক দড়িতে না হলেও একই দিনে তাদের ফাঁসিতে ঝুলতে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

বিচার যেমন পেয়েছেন অনেকেই, তেমনি বিচার পাবেনও না অনেকেই। লক্ষ-লক্ষ শহীদের শত-সহস্র হত্যাকারীর সবার বিচার হবে না সেটাও বাস্তবতা। যেমন কোনদিনও বিচার হবেনা আমার প্রয়াত শ্বশুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডেরও।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেয়ার আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তার চিহ্নিত খুনি মাওলানা মান্নানের। সৌভাগ্য মান্নানের, দুর্ভাগ্য শহীদ আলীম চৌধুরীর পরিবারের। তবে সন্তুষ্টি তো আছে। তারা জানেন এদেশে এখন বিচার হয়। মাওলানা মান্নান আজ বেঁচে থাকলে বিচার হতো তারও।

আর এইটুকু যে কতবড় প্রশান্তি তা শুধু ভুক্তভোগী-ই জানে। বুলেট ট্রেনে আমার কি কাজ, যদি সেই ট্রেনে বসে কেউ আমার গলাটা কেটে দেয় আর তার বিচার না হয়? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদেশকে দিয়েছেন অনেক, দিবেনও অনেক - এই বিশ্বাস আছে। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দিয়ে তিনি এদেশকে যা দিয়ে গেলেন তার সুফল এ জাতি ভোগ করবে আরো শত-সহস্র বছর।

বিচারহীনতা কাকে বলে জানেন? বিচারহীনতা হলো সেই ক্ষমতা যা একজন যুদ্ধপরাধীকে সাহস যোগায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে স্কুল পরিদর্শনে যেয়ে একজন শহীদজায়াকে তাকে স্বাগত জানানোর নির্দেশ দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে যেই শহীদের হত্যাকারী সে নিজে।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মতই তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জটাও অনেক বড়। আমাদের চারপাশে এই যে এতশত অপশক্তি, কেউ পাকিস্তানপন্থী তো কেউ জঙ্গী, কেউ দুর্নিতীর বরপুত্র তো কারো পেশা ইয়াবা- এদের সবার ক্ষমতার উৎসইতো এই বিচারহীনতা। তাদের সর্বাত্মক প্রয়াস থাকবে সময়ের কাটাকে পিছনে ঘুরিয়ে দিতে। ঐক্যও হবে তাই ‘শয়তানের’ সাথে। মনে করার কোন কারণ নেই যে এই ঐক্য শুধু একটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। এর লক্ষ্য সুদূঢ়প্রসারী।

সাম্প্রতিকতম যে রায়টি আজ পত্রিকার শিরোনাম এটি তাদের জন্য সর্বোচ্চ অশনী সংকেত। কারণ এটিই সম্ভবত এদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কফিনে সর্বশেষ পেরেক। শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন এদেশে এখন আর কেউই আইনের উর্ধ্বে নন তা সে আপনি যে-ই হন, যতই বিস্তৃত হোক আপনার কালো হাত আর যতই সংগঠিত হোক আপনার অপরাধ। এই বাংলায় একদিন না একদিন আপনার বিচার হবেই। নিস্তার নেই। বিচারে তাই কার ফাঁসি হলো আর হলোনা তা নিয়ে আমি বিচলিত নই মোটেই। বিচার হয়েছে এটি-ই আমার কাছে মুখ্য।

এসব বিষয় আপনি যত ভাল বোঝেন তারচেয়েও বেশি বোঝে বিচারহীনতার বেনিফিশিয়ারিরা। যারা চিহ্নিত তারাতো আছেই, এখন তাই প্রকাশ্যে আসছে এতদিন আমাদের আশেপাশেই ঘাপটি মেরে থাকা বর্ণচোরারাও। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরপরই যাদের আমরা দেখেছি তৎকালীন বিরোধী দলের দায়িত্বশীল পদে থেকে জনসভায় গরম বক্তৃতা দিতে কিংবা নেতৃত্ব দিতে আইনজীবীদের প্রতিবাদী মিছিলে, তারাই আজ তাই বিপরীত শিবিরে। এদের আমরা হয় চিনতাম না, কিংবা চিনলেও চিনতে চাইতাম না।

এদের কেউ কেউ সংবিধানের প্রণেতাদের একজন তো কেউ আবার স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে প্রগতীশীল ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা। অথচ আজ এরাই সব দুষ্টু গোয়ালে সামিল। আর তাদের সাথে সামিল হয়েছেন বিভ্রান্ত একদল সুশীলও। এরা জানে যে হয় এইবার নয়তো কখনোই না। সেই বাংলাদেশ থেকে এই বাংলাদেশের এই যে উত্তরণ এবং তারও বেশি কিছুর যে প্রবল সম্ভাবনা, তাকে এরা টুটি টিপে মারতে চায় দু’হাতে।

এখন সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে, আমাকে, আমাদেরকে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি শহীদ নোমানের রেখে যাওয়া বাংলাদেশ চাই, না সেই বাংলাদেশ চাই যেখানে পরীক্ষার হলে নোমানদের শরীরে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার আগে হন্তারকের হাত কাপবে শতবার। আর যদি দ্বিতীয়টি আপনার চাহিদা হয়, তবে আসুন সবাই, সব ভুলে সিদ্ধান্ত নেই এই বাংলাদেশকে আমরা আর পিছনে হাটতে দিব না।

বছর শেষের সেই দিনে আমাদের সংবিধান প্রদত্ত সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রয়োগে আমাদের কোন ভুল হবে না। এবারের লড়াই আমাদের - ওদের চূড়ান্ত লড়াই। যিনি নিজের উর্ধ্বে উঠে পরিণত হয়েছেন ‘বাংলাদেশের মা’য়ে’। আসুন বছর শেষে আমরা সবাই তার ঢোল-ই বাজাই।

লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম