সাহিত্য

যদি তুমি ফিরে না আসো

যদি তুমি ফিরে না আসোতুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেতুমিআছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছোআয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছোতোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তুহীন উদ্যানের পথ, দেখছোতোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেতুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুলআমি ভাবতেই পারি না।যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমিআমাকে ভুলে যেতে পারো,যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়াকোনো উপন্যাস, তখন ভয়কালো কামিজ প’রে হাজির হয় আমার সামনে,পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,তখনএকটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে,আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতেঅবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমনভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।বিদায় বেলায় সাঝটাঝ আমি মানি নাআমি চাই ফিরে এসো তুমিস্মৃতি বিস্মৃতির প্রান্তর পেরিয়েশাড়ীর ঢেউ তুলে,সব অশ্লীল চিৎকারসব বর্বর বচসা স্তব্দ করেফিরে এসো তুমি, ফিরে এসোস্বপ্নের মতো চিলেকোঠায়মিশে যাও স্পন্দনে আমার।আসাদের শার্টগুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তেরজ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্টউড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়েনক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনোহৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়বর্ষীয়সী জননী সে-শার্টউঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে ।ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিতমায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্টশহরের প্রধান সড়কেকারখানার চিমনি-চূড়োয়গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচেউড়ছে, উড়ছে অবিরামআমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায় ।আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জাসমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।সুধাংশু যাবে নাপাগলামী করিসনে বন্ধু সুধাংশুসময় যে পার হয়ে যাচ্ছেএবার যে তোর পালানোর বেলাজিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা।জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশুদাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশানসম বাস্তুভিটায়সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলাকিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা।আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশুসেই একপাল বন্ধুগুলো রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকেপ্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলাকিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।আমি বুঝি তোর শঙ্কা আগামী বিরহ বেদনার বন্ধু সুধাংশুআড়াই যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা আত্মার সম্পর্কএই বাস্তুভিটার সাথে আর একঝাঁক বন্ধুর ভালবাসা প্রাণঢালা।কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।কোথায় সেই কল-কাকলীতে মুখরিত সবুজ সুন্দর কাপালী-ভিটাটি বন্ধু সুধাংশুদু’টি জীর্ণ-শীর্ণ ঘর চির-দুঃখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ সেই কাপালী ভিটায়।কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলী আরও সেই প্রিয় বন্ধুগুলাওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা।তুই কি জানিস বন্ধু সুধাংশুতোর বিদায়ে ভীষণ ব্যথা পাবে আমার ঐ ছ’বছরের অবুঝ বোনটি ‘নেহা’কাটাবে কত সন্ধ্যা অধীর প্রত্যাশায়, সুধাংশু ভাইকে জড়িয়ে ধরবেঃ কোথায় চকলেটগুলা?তবুও তোকে পালাতে হবে যে, এবার তুই পালা।আরও জানি বন্ধু সুধাংশুতোর ষোড়শী বোনটি ‘মিলা’ দুষ্টামির ছলে আর বলতে পারবে নাঃ আলমদা তুমি এত কৃপণ কেন?চলো মেলায় নিয়ে, কিনে দিতে হবে সুন্দর একটি মালা।তথাপি তোকে পালাতে যে হবে, এবার তুই পালা।তোকে যে বলা হয় নি বন্ধু সুধাংশুমিলা’র সহপাঠী আমার ভাইটি ‘রিপন’ বলছিল সেদিনঃ ভাইয়া মিলা’টা যা সুন্দর হয়েছে না!বলে দিয়েছি ওকে, সুন্দরী মেধাবী মিলা বিশ্ব জয় করবে, তোর মতো গর্দভটি ওর দিকে তাকাবে না।তোর হাতে যে সময় নেই বন্ধু, এবার তুই পালা।মিলাকে যে বিশ্ব জয় করতেই হবে বন্ধু সুধাংশুঅসাধারণ সুন্দরী মেধাবী মিলার জন্য এক ধর্ষিত, অচ্ছুৎ, অভাগী নারীর জীবনহবে মানবতার জন্য এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা।তাই আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা।কখনো আমার মাকেকখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়েআমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানোবয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গানলতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীরসংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূরজানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখলকোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকেঅথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোনধুয়ে মুছে বাসন-কোসনসেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতেআমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরেঅবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি নাএতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকেরেখেছেন বন্ধ ক`রে আজীবন, এখন তাদেরগ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধুন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!এইচআর/আরআইপি

Advertisement