প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ হলেও তা মানছেন না যমুনা নদীর টাঙ্গাইল অংশের জেলেরা। যমুনার পাড়জুড়ে দুর্গম চরাঞ্চল হওয়াসহ নদীতে প্রশাসনের তৎপরতা কম থাকায় এ অঞ্চলে দেদারছে চলছে মা ইলিশ নিধন। মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যমুনা নদীতে মা ইলিশ নিধন বন্ধে কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা ইলিশ নিধন বন্ধে যথেষ্ট কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
Advertisement
এ সুযোগে রাতে ও দিনে জেলেরা যমুনা নদীতে কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে মাছ ধরছে। এর ফলে প্রতিদিন গড়ে যমুনা নদীর টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুরের ছলিমাবাদ, ভূঞাপুর ও কালিহাতী উপজেলার বঙ্গবন্ধুসেতু অংশ থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ টন মা ইলিশ নিধন হচ্ছে। তবে এ নিয়ে জেলেদের অভিযোগ নৌ পুলিশ ও মৎস্য কর্মকর্তাদের টাকা আর মাছ দিয়ে যমুনায় এই ইলিশ মাছ ধরছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল থেকে যমুনার ভাটিতে নাগরপুরের ছলিমাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীজুড়ে মা ইলিশ ধরা হচ্ছে। এরমধ্যে ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল, গোবিন্দাসী, চর ভূঞাপুর ও মাটিকাটা। কালিহাতী উপজেলার বঙ্গবন্ধুসেতু সংলগ্ন গড়িলাবাড়ি, বেলটিয়ার মুকতলা ও আলীপুর। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলী, কাকুয়ার চর, গয়নাহোসেন, হুগড়া, বেগুনটাল, সাতানী হুগড়া, দক্ষিন হুগড়া, দুলবাড়ি, আলোকদিয়া, চকগোপাল, খোসাইল, মামুদ নগর ও বোয়ালকান্দি। এছাড়াও নাগরপুর উপজেলার ছলিমাবাদ ইউনিয়নের যমুনা পাড়ের চৌহালীসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ২২-২৩টি পয়েন্টে অস্থায়ীভাবে নিধনকৃত ওই ইলিশ মাছের হাট বসছে।
অস্থায়ী এ হাটে প্রতিদিন ভোরে বিক্রি হয় প্রায় ১৮-২০ লাখ টাকার ইলিশ মাছ। এছাড়াও নদী পাড়ের বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করা হচ্ছে নিধনকৃত ওই মা ইলিশ। জেলেরা প্রতিদিন যমুনা নদী থেকে গড়ে ১৬ থেকে ১৭ টন মা ইলিশ মাছ ধরছে। পরে ইলিশগুলো কয়েকটি পয়েন্টে সাধারণ মানুষ ও মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি করছে মাত্র দুইশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকায়।
Advertisement
এছাড়াও সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বেলুর চর এলাকায় শতশত নৌকাযোগে জেলেরা ইলিশ নিয়ে সেখানে বিক্রি করছে। তবে যমুনা নদীতে মা ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধে মৎস্য বিভাগ ও নৌ পুলিশ নানা প্রতিকূলতার কারণে সীমিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের আফজালপুর গ্রামটি যমুনা নদীর কারণে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ওই এলাকার মানুষের মূল পেশা মাছ ধরা। তারা মা ইলিশ ধরে যমুনার পূর্বপাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্রি করছে। এছাড়া নাগরপুরের পশ্চিমাঞ্চল ছলিমাবাদ এলাকায় জেগে উঠা যমুনার চর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার সীমান্ত হওয়ায় টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয় এবং স্থানীয় মৎস্য বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
অপরদিকে, সিরাজগঞ্জের এলাকা হলেও যমুনা নদী ওই এলাকাকে আলাদা করে রেখেছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সমস্যা সংকুলান হওয়ায় সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন বা চৌহালী উপজেলা প্রশাসন ওই এলাকায় কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারেনা।
যমুনা চরের বেশ কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, ভূঞাপুরের নিকরাইল থেকে নাগরপুরের ছলিমাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীপথ জুড়ে নতুন পুরনো মিলিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি মাছ ধরা নৌকা রয়েছে। নাগরপুর অংশে রাতে নৌকা নামাতে প্রতি নৌকা বাবদ ১০ থেকে ১৮ হাজার টাকা ও খাওয়ার জন্য মাছ প্রশাসনের লোকদের দিতে হয়। এ কারণে অভিযানের খবর আগে থেকে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এছাড়া মৎস্য সমিতির মাধ্যমে নৌকা প্রতি এক থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা তুলে স্থানীয় কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের দিতে হয়। ওপর মহল ম্যানেজ করেই জেলেরা যমুনা নদীতে মাছ ধরছে। জেলেদের অতিলোভ ও অসতর্কতার কারণে প্রশাসনের অভিযানে মাঝে মধ্যে জাল ও মাছ ধরা পড়ে।
Advertisement
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এ বছর প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরা বন্ধে ৫১টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করাসহ এলাকার ৬৫১টি বাজারে অধিদপ্তরের উদ্যোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া ৯টি মাছ ঘাট, ৯৩১টি আড়ৎ, এক হাজার ৪৫০টি বাজার পরিদর্শন করা হয়েছে। অভিযানে ৪.১৬৩ মে.টন ইলিশ জব্দ করে এতিমখানা ও মাদরাসায় বিতরণ, ৪ লাখ ১৯ হাজার ১২ মিটার জাল জব্দ করে আগুনে পুড়ানো হয়েছে। এ সময়ে মা ইলিশ ধরার অভিযোগে ৫৭টি মামলা দায়ের ও ৮৯ হাজার ৭শ টাকা জরিমানা আদায় এবং ৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বেলুর চরে মাছ বিক্রি করতে আসা জেলেরা জানায়, মাছ ধরা নিষিদ্ধ জেনেও পেটের দায়ে মা ইলিশ ধরে বিক্রি করছেন। সরকারিভাবে অর্থ সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও তারা সেই সহায়তা পাচ্ছেন না। এছাড়া মাছ ধরতে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের টাকা এবং মাছ দিতে হচ্ছে। এছাড়াও অনেক সময় প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে নদী থেকেই ওই মাছ জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়।
কালিহাতীর গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের আফজালপুর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক জানান, আফজালপুর পুরো গ্রামটাই নদীর মধ্যে। এখানকার সব মানুষই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সরকারিভাবে কোনো অর্থ সহায়তা তারা পায়নি। মেম্বার হিসেবে সবাইকেই তার সহযোগিতা করতে হয়। ইলিশ মাছ ধরা বন্ধের জন্য যদি সরকার আগে থেকে জেলেদের আর্থিক সহায়তা করতো তাহলে যমুনা নদী থেকে মা ইলিশ নিধন বন্ধ হতো।
টাঙ্গাইল অঞ্চলের নৌ-পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সহকারী পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির আকন্দ জানান, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ নিধন বন্ধে যমুনায় নৌ পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। গত ৭ অক্টোবর (রোববার) থেকে বৃহস্পতিবার (২৫ অক্টোবর) পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার, ৫০১.০০০ মিটার জাল আটক ও পুড়ানো, ২১৩ কেজি মাছ জব্দ করে এতিম খানায় বিতরণ এবং ২১ জনকে বিভিন্ন অংকে মোট ৯৮ হাজার ৩শ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, এ বছরই প্রথম যমুনা নদীকে ‘ইলিশ জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। এই জোন ঘোষণার প্রথম বছর হওয়ায় নদীতে অবৈধভাবে জাল ফেলা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাওয়া যায়নি। যমুনার ঘাটে ঘাটে ইলিশের হাট গড়ে উঠা সম্পর্কে তিনি জানান, এ ধরনের হাট বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।
আরিফ উর রহমান টগর/এমএএস/পিআর