সুন্দরবনে বাঘ নিধনে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে চোরা শিকারিরা। একের পর এক বাঘের চামড়া উদ্ধার সে কথাই প্রমাণ করে। আন্তর্জাতিক বাজারে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়াসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চড়া মূল্য থাকায় বাঘ নিধনে নেমেছে সুন্দরবনের চোরা শিকারিরা। সরকারি হিসেবে এ বনে গত ১৬ বছরে ৫২টি বাঘ হত্যার ঘটনার কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে বাঘ হত্যার সংখ্যা আরও বেশি। বাঘের সংখ্যা হ্রাসের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের তৎপরতা, খাদ্যাভাব ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে। গত সপ্তাহে সুন্দরবনের সন্নিকটস্থ গ্রাম কয়রার গোলাখালী থেকে রোববার একসঙ্গে তিনটি বাঘের চামড়া উদ্ধার হবার ঘটনায় বনবিভাগের কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বনের সম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের উদাসীনতার সুযোগে চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের সম্পদ লুণ্ঠনে তৎপর রয়েছেন। তিনটি বাঘের চামড়া উদ্ধারের ঠিক এক দিন আগে ৮ আগস্ট ৬৯ পিস বাঘের হাড়সহ কয়রা এলাকার দুই চোরা শিকারি এনায়েত হোসেন (২২) ও বাবু হোসেন (১৮) পুলিশের হাতে খোদ খুলনা শহরের লঞ্চঘাট এলাকা থেকে আটক হয়।সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা এখন ১০৬টি প্রকাশ করা হয়। অথচ ২০০৪ সালে বাঘের পায়ের ছাপ গুণে এনএনডিপি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ আছে এমন তথ্য দিয়েছিলো। দুবছর পর ২০০৬ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করে এর সংখ্যা নির্ধারণ করে ২০০টি। গত ১১ বছরে বাঘের সংখ্যা কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। সুন্দরবন সন্নিহিত জেলা বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত সুন্দরবনে বসবাসকারি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বৃদ্ধিতো হয়নি বরং আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে।২৬ জুলাই প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের ঘণত্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় অন্যতম হুমকি মানুষের তৎপরতা তথা অবৈধ শিকার, খাবারের অভাব ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব কমেছে। চোরা শিকারিদের বাঘ শিকার, সুন্দরবনের ভেতরের নদী দিয়ে নৌযান চলাচল এবং বনের পাশে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ বাঘের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরাশিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ থেকে বাঘের চামড়া সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোয় একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়। জানা গেছে, বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার হয়। স্থানীয়ভাবে একটি চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশের চোরা বাজারে একটি চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।সর্বশেষ বন বিভাগের হিসেব অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ৫২টি বাঘ গ্রামবাসী, চোরা শিকারি ও বিভিন্ন ধরনের অপঘাতে মারা গেছে। এ ছাড়া গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নয়টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে সাতটি চামড়া পাওয়া গেছে গত ডিসেম্বরে সুন্দরবনের ভেতরে তেলবাহী জাহাজডুবির পর। শুধুমাত্র সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত ১১ বছরে চোরা শিকারিসহ বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের ১৭টি বাঘ মারা গেছে। পরিবেশবিদদের হিসেব মতে এর সংখ্যা ৩০টি। ২০০১ থেকে ২০১২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ১৬টি পূর্ব সুন্দরবনে আর ১৪টি পশ্চিম বিভাগে মারা যায়। এমজেড/এমএস
Advertisement