সম্প্রতি বিশ্বের সব কটি শেয়ারবাজার দ্বিতীয়বারের মতো বড় ধরনের বিপর্যয় দেখেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ায় মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ নাজেহাল করে ফেলেছে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে। তারা পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে একে অপরের ওপর। এদিকে ইরানের ওপর প্রতিনিয়ত নানান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া পরমাণু চুক্তি সহ নানান কারণে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কে নতুনভাবে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আর বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিস্থিতি দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো সংস্থার বিশ্লেষকদের।
Advertisement
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলা বাণিজ্য যুদ্ধ ফকির করবে বিশ্বকে। বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে ব্রিটিশভিত্তিক বার্তাসংস্থা রয়টার্স আশঙ্কা করছে, আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বেশ ক্ষীণ। ওই জরিপে অংশগ্রহণকারী অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ এবং আর্থিক পরিস্থিতির দূরবস্থার কারনে বিশ্ব অর্থনীতিে আরেকবারের মত সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এই প্রথমবারের মতো আগামী বছরের বিশ্ব অর্থনীতির আউটলুকে সংকোচনের কথা বলা হলো। ২০১৮ সালের শুরুতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী হলেও বছরের শেষে এস দেখা যাচ্ছে তার উল্টে অবস্থা।
চলতি মাসে রয়টার্স চালানো এক জরিপে অংশ নেয় পাঁচ শতাধিক অর্থনীতিবিদ। এই জরিপে মোট ৪৪টি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেমন থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তাদের। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ক্রমশ ভাটা পড়বে। তাদের ধারণা অনুযায়ী আগামী বছর এ ৪৪টি দেশের মধ্যে ১৮টি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হবে এবং ২৩ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিবর্তিত থাকবে। এছাড়া মাত্র তিনটি দেশের প্রবৃদ্ধির সামান্য অগ্রগতি হবে বলে জনান তারা।
Advertisement
গত বছরের জানুয়ারিতে রয়টার্সের পরিচালিত এক জরিপে বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদিতা থেকে সৃষ্ট ঝুঁকির বিষয়টির ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর সাম্প্রতিক এ জরিপটি বলছে, জরিপে অন্তর্ভূক্ত ৪৪টি দেশের মধ্যে ৭০ শতাংশ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাকিং ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি এর বৈশ্বিক অর্থনীতি বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ জ্যানেট হেনরি বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা খুব সাধারণ গতিশীলতা রয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং তার বিপরীতে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এই অসমতার কারণে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে অনেক উঠতি বৈশ্বিক বাজার বিপদের মুখে পড়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিজেদের অর্থনীতিকে ক্ষতির মুখ থেকে বাঁচাতে সুদের হার বৃদ্ধি করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদেকে তাদের এ নীতির কারনে অন্য দেশগুলো নানারকম আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। যার কারণে বিশ্বে বাণিজ্য উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় দেড়শ অর্থনীতিবিদের সিংহভাগই জানিয়েছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে আসন্ন সংকটের জন্য মুলত দুটি বিষয় দায়ী। এর মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনার বৃদ্ধি এবং অন্যটি কঠোর আর্থিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারে মারাত্মক দরপতন।
Advertisement
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি আরও ‘দরিদ্র ও বিপজ্জনক’ হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে আইএমএফ। তারা বলছে, ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমতে পারে শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ। সংস্থাটি তাদের সর্বশেষ বিশ্ব অর্থনৈতিক মূল্যায়নে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ২৫ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের চীনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পাশাপাশি সম্প্রতি আবারও ২৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে। বেইজিংও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা কিছু পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ নেইল শিয়ারিং বলেন, ‘প্রথমত বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধে কেউই জয়ী হয় না। যদি বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে সর্বনিম্ন ক্ষতিও হয় তারপরেও বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে আসবে এবং একটা স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে বিশ্ব অর্থনীতি।’
এসএ/জেআইএম