মতামত

সাধারণের জন্য আছে কিছু

পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদে চাকুরি। রাজধানীর বাইরের একটি কলেজে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়ছে ছেলেটি। গ্রাজুয়েশন শেষ করেই আমার নম্বর জোগাড় করে ফোন করে দেখা করতে আসে। এরপর বেশ ক’বারই এসেছে। প্রতিবারই অনুরোধ করছে স্যার একটু কাউকে বলে দেন। বলি, কাকে বলব? সে কতকগুলো নাম বলে। চিনি আমি তাদের, দু’একজনের সাথে সম্পর্কটা বেশ ভালও। কিন্তু কি বলব তাদের? ছেলেটি বলে চলে নিজের দারিদ্র্যের কথা, ছোট ছোট ভাইবোনকে তারই মানুষ করতে হবে, লেখাপড়া করাতে হবে। বাড়তি দায়িত্ব বোনদের বিয়ে দেয়া। অতি দরিদ্র পরিবারের একটি ছেলে চেয়েছিল যত দ্রুত কর্মজগতে প্রবেশ করা যায়। তাই চেষ্টার অন্ত নেই।বলি তুমি কি নিশ্চিত জায়গামতো বললেই চাকুরি হবে? পরীক্ষা, মেধা এসব কোনো বিষয় নয়? সে বলে অবশ্যই স্যার যোগ্যতা বিষয়, কিন্তু পরীক্ষা নয়, তদ্বিরটাই আসল। আরেকদিন সে জানায়, বলতে হবে, সে ছাত্রলীগ করে। আমি বলি, তাহলোতো তোমার কোনো সমস্যাই নেই। নেতাদের ধর। সে বলে, আমি গরিব ছাত্রলীগ কর্মী, তাও ঢাকার বাইরের, কেন্দ্রীয় নেতারা আমাদের পাত্তা দেয়না। ওর পীড়াপিড়িতে একজনকে বলি, কিন্তু এর চাকুরিটি হয়নি। ছেলেটি আমায় বলে, স্যার যোগ্যরা তো সফল হবেই। কিন্তু যারা সাধারণ তারাতো এমনিতে অযোগ্য। বলে, আমাদের মাথার ওপরে সবসময় একটা গনগনে সূর্য থাকে, আমরা পারি না।       পরীক্ষা হয়েছে আরেকটি বড় শহরে। ছেলেটি বলে, আমাদের মধ্যে যারা গ্রাম বা মফস্বল থেকে অাসি তারা ভারী ব্যাগ কাঁধে এসে থেকেছে স্টেশনে, সস্তা হোটেলে। কোনোরকমে খেয়ে দেয়ে  ফেরার পয়সা বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা যাদের থাকে তারা কি স্যার শহুরেদের সাথে পারে? আমি কিছু বলতে পারি না। এরা এমনভাবে হেরে যায় শুধু পুলিশের চাকুরিতে নয়, আরো কত প্রতিযোগিতায়। আমরা এদের দেখি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ফর্ম তোলার সর্পিল লাইনে, সরকারি দফতরে নিম্নপদস্থ কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলে, কোনো হায় হায় এনজিও’র সামনে। এমনও হচ্ছে যে, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা যেখানে চাওয়া হচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মাস্টার্স করা মুখ। এসব ছেলেমেয়েরা কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হয়তো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন করেছে, সাংস্কৃতিক চর্চা করেছে। কিন্তু সব ছেড়ে, জীবনের প্রয়োজনে এখন লাইনে দাঁড়িয়ে। হাজার হোক চাকরিতো।     আমরা কথায় কথায় আইটি খাতের চাকুরি, ব্যাংকের ফ্যাশনেবল, উচ্চ বেতনের চাকুরি, হোয়াইট কালার কর্পোরেট জবের কথা বলছি। কিন্তু একবার ভাবলেই পরিষ্কার হয় এসব চাকুরিতে যেসব দ্যূতিময় চকচকে ছেলেমেয়েদের কাজ করতে দেখি এদের কতজন আসে গ্রাম, মফস্বলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে? তাই ব্যক্তিখাতের অগ্রসরতা ঘটলেও এসব ছেলেমেয়েরা ভাবে, তাদের এসব ঝকঝকে অফিসের চকচকে চাকুরি ওদের জন্য নয়। তারা তাই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে সরকারি দপ্তরের করণিকের চাকুরির জন্য, কিংবা উর্দি পড়ার জন্য।   প্রতিবছর, বিএ, বিকম, বিএসসি, তেমনিভাবে এমএ, এমকম, বা এমএসসি ছাড়াও হাজারো ছেলে মেয়ে বিবিএ, এমবিএ, আরো কতসব ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে, তার হিসেব জানা নেই। এই হাজারো পাশ হওয়া ছেলেমেয়েদের বড় অংশ আসে গাঁ-গঞ্জ বা ছোট শহরের দরিদ্র পরিবার থেকে। কোথাও কি কোনো কিছু আশা করার আছে এদের জন্য?ছেলেটি আমাকে বলে, আমাদের বেকার সময় দীর্ঘায়িত হতে থাকে, সেই সাথে দীর্ঘতর হতে থাকে খরচের বহর, হতাশার দীর্ঘশ্বাস। বলে, আপনারা বলেন, কেন আত্মনির্ভরশীল হওনা? উপদেশটি ভাল, কিন্তু বাস্তবায়নের পথেও কিন্তু সেই শ্রেণি বিভেদ। ব্যাংকের কাছে ঋণ চাইলে হাসেন কর্মকর্তারা।   ছেলেটির এসব কথা সব হয়তো সত্য নয়। কিন্তু আমরা যে সমাজ গড়ে তুলছি, সে সমাজ কেবলই উপহার দেয় চিন্তার দৈন্যতা আর আত্মবিশ্বাসের অভাব। তবু এসব গাঁও গ্রামের সন্তানদের কেউ যখন ছোট উদ্যোগের অনিশ্চিত সরণিতে পা রাখতে চায়, তখন তার জন্য অপেক্ষা করে অজস্র কাঁটা। আমলাতন্ত্র মোকাবেলা করা, দলীয় ক্যাডারদের পাওনাগণ্ডার হিসাব দেয়া, ব্যাঙ্ক কর্মীদের লাভের গুড় মিলিয়ে দুর্নীতির যে চক্রব্যূহ সে সব ছিঁড়ে নিজের ছোট কর্মোদ্যোগের জন্য ঋণ জোগাড় করা কঠিন এদের জন্য। সমাজকে এমন এক স্থানে এনে দাঁড় করিয়েছি যে, কারো জন্য সবকিছু শুন্য। কারো জন্য সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে সে। যদি ক্ষমতার কাছাকাছি একবার পৌঁছে যেতে পারে, যদি কারো দুর্বৃত্তায়নের যোগ্যতা থাকে তবেতো তার জন্য সকলই শোভন, সকলই বিমল। এইচআর/এমএস

Advertisement