মুক্তির আগে ‘দেবী’ সিনেমা নিয়ে একরকম উৎসব আমেজ বিরাজ করছিল শোবিজে। সিনেমাপ্রেমীরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ছবিটির জন্য। কিন্তু মুক্তির ঠিক একদিন আগেই শোকের চাদরে ঢেকে গেল বাংলাদেশ। সেই শোক ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুকে হারানোর।
Advertisement
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সে শুক্রবার বিকেল ৪টায় ছবি দেখার ব্যাপারটি। তাই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জীবন গতিশীল সেটার প্রমাণ দিতে হাজির হই। পরিপূর্ণ সিনেপ্লেক্সের আঙিনা। ‘দেবী’র টিকিট পেয়ে সবার মুখে যেন রাজ্য জয়ের হাসি।
পুরো দুই ঘণ্টা মুগ্ধতা আসে ‘দেবী’কে পর্দায় দেখতে দেখতে। ছবিটি শোকের ক্ষতে খানিকটা সুখের প্রলেপ দিতে পারলো বলে মনে হয়েছে। সহজ করে বলতে গেলে- ‘ভালো লেগেছে দেবী সিনেমা, ভালো লাগার মতোই ছবি নির্মাণ করেছেন অনম বিশ্বাস’।
গল্পই নায়ক, গল্পই ভিলেন-
Advertisement
অনেক কারণেই ছবিটি নিয়ে দর্শকের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণটি হলো হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে সিনেমা। আর সেটিও আবার তার সৃষ্ট তুমুল জনপ্রিয় ‘মিসির আলী’-কে প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রে দেখার সুযোগ। অনেকেই হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। তবে তৌকীর আহমেদের ‘দ্বারুচিনি দ্বীপ’ এবং আবু সায়ীদের ‘নিরন্তর’ ছাড়া অন্য ছবিগুলো হতাশ করেছে দর্শকদের।
তাই এবারও সেই ভয়টা ছিল। যে মিসির আলীকে হুমায়ূন আহমেদ নিজে কখনো সিনেমায় আনার সাহস দেখাননি সেই মিসির আলীকে কেমন দেখিয়েছেন নবীন চলচ্চিত্র নির্মাতা অনম বিশ্বাস, তিনি কী হুমায়ূন সাহিত্যের চিরচেনা আমেজটা সিনেমায় তুলতে পারবেন? ছবি শেষে উত্তর যা পেলাম তা হলো একজন কখনোই অন্যজনের মতো নয়। সেই চেষ্টা করা যায় মাত্র। ‘দেবী' উপন্যাস তার মতো, 'দেবী' সিনেমা হুমায়ূন সাহিত্যের অনুরাগী অনম বিশ্বাসের ভাবনার মতো। তিনি চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি হুমায়ূনীয় ফ্লেভার রাখতে। সহজাত হাস্যরসও আছে সিনেমায়।
‘দেবী’র গল্পটিই এই ছবির মূল নায়ক। নির্মাতা কেবল চিত্রনাট্যে সেটাকে সময়োপযোগী করেছেন। নীলুর প্রেমের বেলায় চিঠির জায়গায় এসেছে হালের ম্যাসেঞ্জার। কম বয়সী রানুর বয়স্ক স্বামীর পরিবর্তে সিনেমায় দেখা গেছে সমবয়সী রানু ও আনিসের দাম্পত্য জীবন।
তবে, গল্প থেকে চিত্রনাট্যে আরোপিত পরিবর্তন খানিকটা বিরক্তিরও ঠেকেছে। একটা জনপ্রিয় উপন্যাসকে সময়ের সঙ্গে আপডেট করার কোনো যুক্তি পাইনি। হয়তো ১৯ বছরের রানুর চরিত্রে জয়া আহসানের অভিনয়টাকে সিদ্ধ করতেই এত পরিবর্তন। কিন্তু এতে হুমায়ূনের যে 'দেবী' তার থেকে অনেকটাই সরে এসেছে সরকারি অনুদানের সিনেমা 'দেবী'। বারবার মনে হয়েছে, ছবিটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপটেই বেশি ভালো লাগত। চিঠির প্রেমের প্রতি এখনো মানুষের অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। নীলুকে সেই প্রেমেই ভালো লাগতো। এখানে গল্পটি ভিলেন হয়ে হাজির হয়েছে।
Advertisement
আবার পরিচালককে বাহবা দিতে চাই তিনি উপন্যাস থেকে ভয়ের ব্যাপারটি হুবহু তুলে ধরতে পেরেছেন। 'দেবী' উপন্যাস হাতে নিয়ে যেমন গা শিরশির করে, ভয় আঁকড়ে ধরে 'দেবী' সিনেমাতেও সেটা উঠে এসেছে। অনেকেই মজা করে ছবিটিকে ভৌতিক ছবিও দাবি করছেন।
অভিনয়
'দেবী' সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি এর অভিনয়শিল্পীরা। অভিনয়ে নিজেদের অনন্য করে তোলা চঞ্চল চৌধুরী ও জয়া আহসানের অভিনয় নিয়ে কিছু বলার নেই। মিসির আলী চরিত্রে অনবদ্য সঙ্গে কারও তুলনাই করা ঠিক হবে না। পরিবর্তিত রানু চরিত্রে জয়া নিজেকে আরও একবার প্রমাণ করলেন।
তবে এই সিনেমা দিয়ে অভিষিক্ত হওয়া শবনম ফারিয়ার অভিনয় মুগ্ধতা দিয়েছে। শান্ত স্বভাবের নীলু চরিত্রে বেশ সাবলীল ছিলেন তিনি। গল্প প্রধান সিনেমায় তার আরও মনোযোগী এবং নিয়মিত হওয়া উচিত।
রানুর স্বামী আনিস চরিত্রে অনিমেষ আইচ সাদামাটাই। বাড়তি কিছু ছিল না তার উপস্থিতিতে। ইরেশ যাকেরও ছিলেন সাধারণ। সিনেমা দেখা শেষে অনেকেই বলছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ দেবী বানালে এই চরিত্রগুলোরও যত্ন নিতেন।
ভালো হয়, ছবিটি দেখতে বসে একটি মৌলিক সিনেমা দেখার অপেক্ষা করা। হুমায়ূন আহমেদের 'দেবী' উপন্যাসটি কেবল একটা উৎস মনে করা। তাহলে, একজন দর্শক হিসেবে আনন্দ পাওয়া যাবে, চাপমুক্ত থাকা যাবে।
গান
উপমহাদেশীয় সিনেমায় গান একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি বানাতেন না। তার সিনেমায় গল্প আর সংলাপই ছিল মূল প্রাণশক্তি। তবুও তিনি গানে মনোযোগ দিতেন। তার প্রায় সব ছবিতেই অন্তত একটি গান আলোচনায় আসতো, জনপ্রিয় হতো। কিন্তু 'দেবী' বানাতে গিয়ে পরিচালক গানে মন দেননি। কলকাতার ক্রেজ অনুপম রায়কে নেয়ার চমকটা সফল হয়নি। গানটি পৌঁছায়নি সবশ্রেণির শ্রোতাদের কাছে। গানের জনপ্রিয়তা দেবীকে আরও সর্বজনীন করতে পারতো।
টেকনোলজি
এখনকার ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে আক্ষেপ বা দুর্বলতা টেকনোলোজিতে। কিন্তু 'দেবী' দর্শকের সেই আক্ষেপ দূর করবে। চমৎকার ঝকঝকে চিত্রগ্রহণে মুগ্ধ হবার মতো নির্মাণ। লাইটিং দারুণ। আলোছায়ার খেলা মন ভরায়। রানুর কল্পনায় ভৌতিক রাতগুলো বেশি ভালো লাগে।
মেকআপে অতি সিনেমাটিক কিছু নেই। মিসির আলীকে লেখকের বর্ণনা অনুযায়ীই তুলে ধরার চেষ্টা সফল। জয়াকে সাধারণ সাজ-পোশাকে দেবীর মতো উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। নির্মাতা মনোযোগ দিয়েছেন তার চোখে। পুরো সিনেমাতেই জয়ার মুখের চেয়ে চোখই বেশি কথা বলেছে।
সাউণ্ড সিস্টেমও দারুণ। ডাবিং ভালো ছিলো বলেই স্পষ্ট হয়েছে সংলাপ। ভৌতিক সাউন্ডগুলোও ভয় ধরিয়ে যায়। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে মানিয়ে গেছে।
শেষকথা
একটি জনপ্রিয় গল্পকে, চরিত্রকে সিনেমার পর্দায় নিয়ে আসা অনেক চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য ছবির প্রযোজক জয়া আহসান ও নির্মাতা অনম বিশ্বাসকে ধন্যবাদ। তারা হুমায়ূন আহমেদের প্রতি মনোযোগী ছিলেন এই সততার জন্যও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য তারা।
বলে রাখা ভালো, সবশ্রেণির দর্শকের ছবি 'দেবী' হয়তো নয়, যারা গল্পপ্রধান সিনেমা পছন্দ করেন তারা চোখ বন্ধ করে 'দেবী' দর্শনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এখানে মসলাদার সংলাপ নেই, গান বা মারপিট নেই।
আছে গল্পের চমৎকার গাঁথুনি। আছে একটি ভালো সিনেমা নির্মাণের চেষ্টা। সিনেমার ক্রান্তিলগ্নে ভালো ছবি নির্মাণের খরায় 'দেবী' অনেক সাহসী পদক্ষেপ, অনুপ্রেরণার।
এলএ/জেডএ/এমএস