১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পার করেছে প্রতিষ্ঠার ৬৫ বছর। এই বিদ্যাপীঠের পঠন-পাঠন ও গবেষণা দেশের উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণা ও উন্নয়নে কত দূর এগিয়েছে- এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান।
Advertisement
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সালমান শাকিল।
জাগো নিউজ : প্রথম মেয়াদে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে এসে কোন বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন ?
ড. এম আব্দুস সোবহান : বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব গবেষণা কার্যক্রম। আমরা গবেষণা কার্যক্রমের ওপর জোর দিচ্ছি। এজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। আমরা সেটির ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছি। পাশাপাশি বিশ্বমানের মানুষ তৈরিতে এক্সট্রা কারিকুলার (নিয়মিত পাঠক্রম বহির্ভূত) ও কো-কারিকুলার কার্যক্রমের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
Advertisement
জাগো নিউজ : বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সিলেবাস আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন?
ড. এম আব্দুস সোবহান : যারা সিলেবাস তৈরি করেছেন, যে বিভাগ করেছে তারা তো সবকিছু চিন্তা করেই করেছেন। প্রতি বছরই তা আপডেট হচ্ছে। এখন বিষয় হলো, ভালো একটি জিনিস দাঁড় করানো হলো, কিন্তু চর্চা হলো না।
সিলেবাসে ঠিকই আছে কিন্তু পড়ানো হচ্ছে না। অন্যদিকে পড়ানো হচ্ছে কিন্তু শিক্ষার্থীরা সবকিছু গ্রহণ করছে না। এসব বিষয়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে গতানুগতিক সিলেবাস না করে তা আধুনিকায়নের প্রয়োজন আছে। আমরা সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছি।
জাগো নিউজ : বাধ্যবাধকতা না থাকায় শিক্ষকরা ক্লাসে উপস্থিত হন কম- এমন অভিযোগও আছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
Advertisement
ড. এম আব্দুস সোবহান : বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি আমরা চেয়ে নিয়েছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন মানে এই নয় যে, আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে সেটি পালন করি বা না করি, তাতে কিছু যায়-আসে না। শিক্ষকদের জবাবদিহিতা তার নিজের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট আছে, অর্ডিন্যান্স আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়। তার মানে কি আমি সরকার থেকে আলাদা? সরকার তো আমাদের বাজেট দেয়। আসলে ব্যাপার হলো, লিখিত কিছু নাই। সব কথা বলা আছে। কিন্তু বলা নাই, শিক্ষকরা কখন আসবেন, কখন যাবেন। নির্ধিদায় আমি বলবো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে উন্নত চিন্তা, উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন; সেটি আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ছাত্ররা কৈফিয়ত তলব করতে পারছে না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
জাগো নিউজ : দিন দিন শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরি ও ক্লাসবিমুখ হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
ড. এম আব্দুস সোবহান : কেউ যদি জানতে চাই, জানার কিন্তু অনেক মাধ্যম আছে। তার মধ্যে একটি হলো, তাকে পড়তে হবে। পড়াশোনা করে জানবে। আরেকটি হলো, বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্য দিয়ে জানবে। পড়াশোনার মাধ্যমে জানার বিষয় হলো পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে জানা। বাকি যে জ্ঞান আহরণ, সেটি তার পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। রাজনীতির বই পড়বে, কবিতার বই পড়বে, গল্প-উপন্যাস পড়বে। পড়ার অভ্যাস থাকা জরুরি। সেজন্য লাইব্রেরিতে অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসবিমুখ বা লাইব্রেরিবিমুখ হচ্ছে, আমি এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাই না। আরেকটা বিষয় হলো, ক্লাস বা লাইব্রেরিবিমুখ হওয়া ডিসিপ্লিনের ওপর নির্ভর করে। ইঞ্জিনিয়ারিং বা এগ্রিকালচার- এসব বিষয়ে তুলনামূলকভাবে শিক্ষার্থীদের বেশি ক্লাসে যেতে হয়। তবে পড়ার অভ্যাসটা থাকা জরুরি।
জাগো নিউজ : গবেষণা প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে জমা দেয়া হয় না- এমনও অভিযোগ আছে…
ড. এম আব্দুস সোবহান : প্রকল্পগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে। একটি হলো জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমি, আবার বিশ্ববিদ্যালয়েরও নিজস্ব প্রকল্প আছে। যারা প্রকল্পগুলো নিচ্ছেন তারা সময় মতো সাবমিট করছেন কিনা- সেটি হলো বিষয়। সময় মতো বলতে কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। তবে তাদের যে গবেষণা এবং এজন্য যে টাকা-পয়সা দেয়া; আসলে তারা কি আউটপুট দিচ্ছে? অবশ্যই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
জাগো নিউজ : দেশের উত্তরাঞ্চল হলো কৃষিপ্রধান। এ অঞ্চলের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়টি কতটুকু ভূমিকা রাখছে?
ড. এম আব্দুস সোবহান : সমগ্র দেশের উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়। উত্তরাঞ্চল মূলত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ফ্যাকাল্টি করেছি, সেখানে গবেষণা চলছে। এখানে তো সেই মানুষ তৈরি হবে যারা দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রাখবে। আমি মনে করি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের যে ভিশন ও মিশন সেটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি আধুনিক বাংলাদেশ তৈরিতে সরকারের পদক্ষেপের অংশীদার হিসেবে কাজ করছে।
জাগো নিউজ : আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পিছিয়ে পড়ছে?
ড. এম আব্দুস সোবহান : আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ের কথা যদি বলি, দেখা যাচ্ছে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। র্যাংকিংয়ের উন্নতি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও গবেষণালব্দ প্রকাশনার ওপর নির্ভর করে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি কালচারালি কত উন্নত, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের স্বীকৃত কিনা- এসব বিষয় বিবেচ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা, সংস্কৃতিচর্চা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর সুযোগ আছে। তবে র্যাংকিং না বাড়ার পেছনের বড় কারণ হলো, আমাদের তেমন প্রচারণা নেই।
জাগো নিউজ : বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা কার্যক্রম কতটুকু এগিয়েছে?
ড. এম আব্দুস সোবহান : আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) চুক্তি স্বাক্ষারিত হয়েছে। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা আছে। আগামীতে জাপানের হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা হবে, আসছে ডিসেম্বরে সেখানে ভিজিট করতে যাব। আবহাওয়া নিয়ে গবেষণার জন্য হিমালয়ের পাদদেশের দেশগুলোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত কমিটির সদস্য হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া চলতি মাসের ৩০ তারিখে নেপালের হিমালয়ান ইউনিভার্সিটি অব কনসোর্টিয়াম পরিদর্শনে যাব।
জাগো নিউজ : সিনেট অপূর্ণ রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত…
ড. এম আব্দুস সোবহান : সিনেট অপূর্ণ রয়েছে- এটা সঠিক নয়। সিনেটের ৩৩ শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে। রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েট ২৫ জন, সেই আশির দশকে একবার নির্বাচন হয়েছে; ২৫ বছর ধরে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। নিয়ম আছে, যতদিন নির্বাচন না হবে ততদিন তারা থাকবেন। শুধুমাত্র অপূর্ণ আছে ছাত্র প্রতিনিধি। বাকি সবাই আছেন। এর কারণ হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন না হওয়া।
জাগো নিউজ : ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কী?
ড. এম আব্দুস সোবহান : আমরা তো প্রস্তুত। কিন্তু যারা নির্বাচন করবে তাদের ভেতরে তো উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখতে পাই না। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে যদি প্রস্তুতি থাকে, তারাই তো আমার কাছে আসবে; বলবে, স্যার একটা তারিখ তাড়াতাড়ি দিয়ে দেন।
আমি চাই, শিগগিরই রাকসু নির্বাচন হোক। নির্বাচন দিতে আমার তো কোনো আপত্তি নেই।
জাগো নিউজ : বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী হবে?
ড. এম আব্দুস সোবহান : উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষকরা ভূমিকা রাখেন। যে দায়িত্ব তাদের কাঁধে অর্পিত হয়েছে তারা যদি সেটি সঠিকভাবে পালন করেন; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যদি তারা নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বিশ্বমানের শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবো।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হন তারা যে মেধাবী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভর্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। তাদের প্রতি আমার আহ্বান, পরিশীলিত দেশপ্রেমিক নাগরিক হতে তারা যেন সংস্কৃতিচর্চা করে।এমএআর/পিআর