অর্থনীতি

ব্যাংক ঋণ কমলেও দেনা বাড়ছে সরকারের

>> তিন মাসে সরকারের ব্যাংক ঋণ ২৮৯২ কোটি টাকা >> মোট ঋণের স্থিতি ৯১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা>> জুলাই-আগস্টে ৯০৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

Advertisement

বেশি মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। যার কারণে বাজেটের ঘাটতি পূরণে বড় অংশই আসছে এখান থেকে। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার খুব একটা চাপ নেই সরকারের। সংশ্লিষ্টরা জানান, অস্বাভাবিক সঞ্চয়পত্র বিক্রি বৃদ্ধি ও বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা আসায় সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা কমেছে। তবে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর অতি নির্ভরশীলতার কারণে সুদের ব্যয় দিনদিন বাড়ছে। ফলে সরকারের সুদ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ করা সহজ হওয়াতে সরকার এদিকে বেশি ঝুঁকছে। যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনিয়ম আর কারসাজির কারণে দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কম। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যও তেমন ভালো নয়। এছাড়া ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহারের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি। যার কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানোর জন্য অনেকেই ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন।’ সঞ্চয়পত্রের এ ঋণের টাকা সরকারকে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির এ বিশ্লেষক। তা না হলে এ ঋণ বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে সতর্ক করেন তিনি। কারণ সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে (গত ৮ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব) উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিট দুই হাজার ৮৯২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। ফলে বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। গত ৩০ জুন পর্যন্ত যা ছিল ৮৮ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এদিকে আলোচিত সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঋণ পরিশোধ করেছে সাত হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে মোট ঋণ গত অর্থবছরের চেয়ে কমে ১৫ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকায় নেমেছে। গত জুন শেষে যা ছিল ২৩ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে রাজস্ব থেকে সরকারের আয় খুব ভালো নয়। তাই বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে। তবে সরকার এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তা খুব একটা বেশি নয়। কারণ বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার তুলনায় অনেক কম নিয়েছে। এছাড়া এখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেশি হচ্ছে।’ তাই প্রয়োজন ছাড়া সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে না বলে মনে করেন এ অর্থনীতি বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন কারণে এখন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কিছুটা কমেছে। এ সময় ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়া খুব একটা সমস্যা হবে না।’ প্রতি বছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে সরকার। এ ঘাটতি মেটানো হয় দুটি উৎস থেকে। একটি অভ্যন্তরীণ, অন্যটি বৈদেশিক খাত। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তীরণ উৎসের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি (২০১৮-১৯) অর্থবছর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। এদিকে গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরলেও অর্থবছর শেষে দাঁড়ায় মাত্র ৯২৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) নিট নয় হাজার ৫৭ কোটি টাকার ঋণ এসেছে সঞ্চয়পত্র থেকে। এ সময়ে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৪ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সুদ বাবদ পরিশোধ হয়েছে তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে সরকার ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। গেল ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১২ মাসে মোট ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা বাবদ পরিশোধে ব্যয় হয় ৩২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। শুধু মুনাফা বা সুদ বাবদ পরিশোধ হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত আগস্ট শেষে প্রবৃদ্ধি নেমে ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা গত ৩১ মাসের সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, সঞ্চয়পত্রে জনসাধারণের বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার ফলে মুদ্রা বাজারে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। সুদহার বেশি হওয়ায় সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই আসছে এ খাত থেকে। এতে বাজারে সুদহার কমানো যেমন সহজ হচ্ছে না, তেমনি সরকারের বেশি সুদবাহী দায় বাড়ছে। অন্যদিকে বন্ড মার্কেট উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য জমছে, যা সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিল বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার যৌক্তিকীকরণে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। এদিকে সংসদে গত বাজেট আলোচনায় অধিকাংশ সংসদ সদস্য সঞ্চয়পত্রে সুদের হার না কমানোর দাবি জানান। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার পুনর্নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরামর্শ ও ব্যাংকমালিকসহ বিভিন্ন মহলের চাপ সত্ত্বেও নির্বাচনী বছরে বহুল আলোচিত সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমানোর সিন্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইআরডিকে (অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ) কাজ করতে বলা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে আগামী নির্বাচনের আগে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই বলে জানান অর্থমন্ত্রী। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেনি। বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদে বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মের পর থেকে এ হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। এসআই/এনডিএস/এমএআর/আরআইপি