বিদেশ মানেই সোনার হরিণ, এই কথাটি বেশ প্রচলিত এলাকায় গ্রামে ও বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে। এই সোনার হরিণের সন্ধানে কত জীবন হারিয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে দেখার সময় কি কারো আছে। প্রবাস মানেই অসহায়ত্ব, একাকিত্ব। প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে থাকার নামই পরবাস। কথায় আছে, যার দেশে কাজ নাই সেই নাকি যায় বিদেশে। বিষয়টি সম্পূর্ণ সত্য না হলেও কিছুটা মিল পাওয়া যায় প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের মাঝে। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অদক্ষ শ্রমিকেরা পাড়ি জমান ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে। নিজের আত্নীয়-স্বজন এমনকি প্রিয়তমা স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে মাসের পর মাস বছরের পর বছর পরবাসী জীবন কাটাচ্ছে লাখো প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধা।
Advertisement
যাদের পাঠানো রেমিটেন্সে এখনো সচল রয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকা, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে তাদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে দেশের প্রতিটি সেক্টরে।
একজন প্রবাসী পাসপোর্ট করতে গেলে দালালদের থেকে শুরু হয় ভোগান্তি। ভিসা, মেডিকেল, ফিংগার প্রিন্টসহ সব ক্ষেত্রেই হাজারো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
ম্যানপাওয়ার নামক আরেক জালিয়াতির কবলেও পড়তে হয় প্রবাসীকে, এখানেই শেষ নয় ভোগান্তির, বিদেশগামী অদক্ষ শ্রমিকদের বেসিক ধারণা দিতে খোলা হয়েছে ট্রেনিং সেন্টার, এখানেও টাকার বিনিময়ে সনদ ও মিলছে। এইসব ধাপ একজন প্রবাসীকে বিদেশ যাওয়ার পূর্বেই পাড়ি দিতে হয়।
Advertisement
এসব ধাপ পাড়ি দেয়ার পর আসে ভিসার পালা, যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সরকারিভাবে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালরা। যে ভিসা ইন্ডিয়া অথবা পাকিস্তানিরা ৫০ হাজার টাকায় নেয়, সেই একই ভিসা বাংলাদেশিরা বিক্রি করছে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা।
গ্রামের খেটে খাওয়া অসহায় মানুষটি তার পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে পরিশোধ করেন ভিসার টাকা। দেশে প্রবাসীদের জন্য একটি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থাকলেও প্রবাসীরা কতটুকু সুবিধা ভোগ করছে এটা একমাত্র প্রবাসীরাই বলতে পারবে।
এভাবেই ভোগান্তির মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু একজন প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধার। দেশের ভোগান্তিই কি শেষ? এত সহজেই একজন প্রবাসীর জীবন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে এমনটি মনে করলে ভুল হবে। প্রবাসে যাওয়ার পর শুরু হয় নতুন এক জীবন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব রেখে নতুন এক দেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে শুরু হয় জীবনের নতুন আরেক সংগ্রাম।
সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় এসে গোসল করে রান্না করতে করতেই রাত ১০টা বেজে যায়। মধ্যপ্রাচ্য রাত ১০টা মানে বাংলাদেশে রাত তখন ১২টা অথবা ১টা।
Advertisement
দেশ থেকে আসা নতুন ছেলেটি চাইলেও তার পরিবারের সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে না। এভাবেই সপ্তাহের ৬টি দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আসে শুক্রবার, সপ্তাহের কাপড় ধোঁয়া ও বিগত ছয়দিনের কাঁচা ঘুম আদায় করেই দিনটি কেটে যায়। এই শুক্রবারই পরিবার বন্ধু-বান্ধব আত্নীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলার সময় পান প্রবাসীরা। এদিকে দেশে পরিবারের লোকজন ভাবতে থাকে ভিন্নকিছু, তারা মনে করে বিদেশ গিয়ে ভুলে গেছে।
একজন প্রবাসী যখনই মাস শেষে বেতন পায়, তখন তার খরচের জন্য অল্প কিছু টাকা রেখে বাকি সব টাকাই দেশে পাঠিয়ে দেয় শুধুমাত্র আপনজনদের মুখে হাসি ফোটাতে। ঠিকমতো না খেয়ে না ঘুমিয়ে উত্তপ্ত রৌদ্রের মাঝে কাজ করে আবার অনেকেই মাসে ঠিকমতো বেতন পায় না। সারামাস কাজ করে যখনই সময়মতো বেতন পান না একজন প্রবাসী, তখনই মানুষিকভাবে ভেঙে পড়েন।
এদিকে দেশে সময়মতো টাকা না পাঠালে ব্যাংকের ঋণের জন্য লোকজন এসে বাড়িতে এসে বসে থাকে! আবার ভাই-বোন স্ত্রীর চাহিদা ঠিকঠাক পূরণ করতে না পারলে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি। এই অশান্তি থেকেই অনেক সংসার ভেঙে যায়।
সকল প্রবাসীদের পক্ষ থেকে পরিবারের প্রতি একটাই চাওয়া, তারা যেন প্রবাসীদের কষ্ট একটু বোঝে। সরকারের কাছে একটাই দাবি, প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের যেনো একটু মূল্যায়ন করা হয়। এই প্রবাসীরাই পরিবার ও দেশের জন্য নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিচ্ছে, অথচ তারা দেশের এক গ্লাস পানিও পান করছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত দেড় কোটি প্রবাসীদের একটাই দাবি তাদের জেনো যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় এবং সরকারিভাবে যেনো প্রবাসীদের বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এমআরএম/আরআইপি