ভারতের কেরালায় সবরীমালা মন্দিরে নারীদের ঢুকতে দেয়াকে কেন্দ্র করে তুমুল সংঘাত ও উত্তেজনা শুরু হয়েছে। নারীদের প্রবেশ ঠেকাতে ওই মন্দিরকে ঘিরে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে ও জোর করে গাড়ি থেকে নারীদের নামিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
Advertisement
সম্প্রতি দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সবরীমালা মন্দিরে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সম্প্রতি তা তুলে দিয়েছেন।
বুধবার থেকে মন্দিরের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা থাকলেও নারীদের প্রবেশ করতে না দিয়ে উল্টো তাদের ওপর হামলা করেছে দেশটির কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা।
বিক্ষোভের মধ্যেই সবরিমালা মন্দিরের ঢোকার চেষ্টা করেন দুই নারী। তাদের সুরক্ষা এবং দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছিল। তবে ভক্ত এবং পণ্ডিতদের তোপের মুখে তাদের মন্দিরের ৫শ মিটার দূর থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে।
Advertisement
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেই কেরালার বাসিন্দা এক নারী বলেছিলেন, ‘দেখবেন, আমরা মেয়েরাই এই প্রথা ভাঙতে পারব না, যতই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিক। এটা আমাদের বিশ্বাস যে, ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মেয়েদের ওই মন্দিরে যাওয়া উচিত নয়।’
সংখ্যালঘু রায় দিতে গিয়ে বেঞ্চের একমাত্র নারী বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রাও এই কথাটাই বলেছিলেন যে, ‘ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসে আদালতের হস্তক্ষেপ অনুচিত।’
ওই মন্দিরে ১০-৫০ বছর বয়সী নারীদের এতদিন প্রবেশ করার অধিকার ছিল না, কারণ ওই বয়সটি নারীদের ঋতুমতী হওয়ার সময়।
সবরীমালায় যে আয়াপ্পার পূজা করা হয়, তিনি আজীবন ব্রহ্মচারী বলেই বিশ্বাস করেন তার ভক্তরা। সেরকম মন্দিরে রজঃস্বলা নারীরা প্রবেশ করলে ঈশ্বর রাগ করবেন বলে বিশ্বাস করেন হিন্দুদের একটা বড় অংশ। এ ছাড়াও ওই মন্দিরে বার্ষিক পূজা দিতে যাওয়ার আগে ৪১ দিন কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয় পুরুষদের। তারা কালো পোশাক পরেন, সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার খান, খালি পায়ে থাকেন, দাড়ি কামান না, আর নারীসঙ্গ তো নৈব নৈবচ (একেবারেই নিষিদ্ধ)।
Advertisement
রজঃস্বলা নারীরা ব্রহ্মচর্য পালন করা পুরুষদের সঙ্গে ওই মন্দিরের পাহাড়ি পথে একই সঙ্গে উঠলে তাদের ব্রহ্মচর্য বিঘ্নিত হতে পারে বলেও ধর্মীয় বিশ্বাস।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই সব বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়েই রায় দিয়েছিল। ওই রায়ের পরে বেশ কিছুটা সময় কেটেছে। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
বুধবার যখন ভগবান আয়াপ্পার বার্ষিক পূজার জন্য পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা ওই প্রাচীন মন্দির খুলেছে, স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষোভ হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে। হাতে গোনা যে কয়েকজন নারী আদালতের নির্দেশে ভরসা করে মন্দিরে যেতে গিয়েছিলেন, তাদের ফিরে আসতে হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নারী বিক্ষোভকারীরাই তল্লাশি চালিয়েছেন যে, কোনো নারী মন্দিরের দিকে এগুচ্ছেন কিনা, সেটা দেখতে।
বৃহস্পতিবার পেশাগত কারণে ওই মন্দিরের পাহাড়ি পথ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক ভারতীয় নারী সাংবাদিক। তাকে প্রথমে বাধা দেয়া হয়, তারপরে পুলিশ বাহিনী কর্ডন করে নিয়ে ওপরে উঠছিল তাকে। কিন্তু সেখানেও পাথর ছোঁড়া হয় তার দিকে।
শুধু যে কেরালার বাসিন্দাদের একটা অংশ সবরীমালায় নারীদের প্রবেশাধিকারের বিরুদ্ধে, তা নয়। পার্শ্ববর্তী অন্ধ্রপ্রদেশের লোকজনও এর বিপক্ষে।
তাদেরও অভিমত, ‘নারীদের প্রবেশের ওপরে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকাই উচিত, কারণ মেয়েদের প্রতিমাসে ঋতুস্রাব হয়। সেই সময়ে মন্দিরে প্রবেশ উচিত নয়।’
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সুপ্রিম কোর্ট একটা রায় দিল, অথচ একটা বড় অংশের নারীরাই তার বিরোধিতা করছেন, এবং সেটাও হচ্ছে এমন এক রাজ্য কেরালায়, যেটি শিক্ষার হারের দিক থেকে ভারতের সবথেকে এগিয়ে থাকা একটি রাজ্য।
কেন নারীরাই লিঙ্গ সমতার এই প্রশ্নে বিরোধিতা করছেন? এর জবাবে পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেন, ‘প্রথমত, শিক্ষিত হলেই যে কোনো নারী বা পুরুষ ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হবেন, তা কিন্তু নয়। আবার আমারা যারা লিঙ্গ সমতায় বিশ্বাস করি, সংবিধান প্রদত্ত সমানাধিকারে বিশ্বাস করি, কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস করি না, আমরা বললেই যে সাধারণ গড়পড়তা নারীদের মনোভাব পরিবর্তন হবে, সেটা আশা করাও অনুচিত।’
এই মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকারের বিরোধিতায় কেরালার বিজেপি এবং তাদের যুব সংগঠন আগে থেকেই সরব হয়েছিল। বৃহস্পতিবার হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতও মুখ খুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে।
তিনি বলেছেন, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি, তাদের সংগঠনও এটা স্বীকার করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তো নারীরা নিজেরাই এই নিয়ম পালন করে থাকেন যে সবরীমালা মন্দিরে তারা যাবেন না- প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে এটা। উচিত ছিল ধর্মগুরুদের সঙ্গে আলোচনা করা, কারণ তারাই তো একমাত্র সঠিক বলতে পারবেন যেকোনো ধর্মে কোন বিষয়টা করা উচিত, কোনটা অনুচিত।
সূত্র : বিবিসি
এমবিআর/জেআইএম