১৯৭২ সালে কিছু গান পাগল তরুণের হাত ধরে যখন দেশের প্রথম ব্যান্ডদল সোলসের যাত্রা শুরু তখনো হাতেখড়ি হয়নি ছোট্ট রবিন তথা আজকের আইয়ুব বাচ্চুর। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রামের মুসলিম বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিক্ষায় ভালো ফল করায় ছেলে আইয়ুব বাচ্চুর হাতে তার বাবা একটি কালো গিটার কিনে দেন। সেই শুরু...
Advertisement
প্রথম দিকে চট্টগ্রাম নগরীর জুবলী রোড এলাকা ছিল গান পাগল কিছু তরুণের ডেরা। তাদেরইও একজন ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। পরিবারের তেমন কেউ গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ঝোঁক। বাবার দেয়া কালো রঙের সেই অ্যাকুয়েস্টিক গিটারেই প্রথম তার আঙুলের টুংটাং ছোঁয়া পড়ে। ওই সময় একদিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারবাদক জিমি হ্যানড্রিকস, রিচি ব্রাকমোর, কার্লোস স্যানটানা, অন্যদিকে দেশের পপশিল্পী আজম খানের গিটারবাদক নয়ন মুন্সীর গিটারে পারদর্শিতা আইয়ুব বাচ্চুকে মুগ্ধ করে।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন ওদের মতো তাকেও গিটারে পারদর্শী হতে হবে। তবে সময়টা তখন বৈরী ছিল। সরাসরি কারও শিষ্যত্ব না পেলেও চট্টগ্রামের রউফ চৌধুরী, বন্ধু নওশাদ ও সাজুর সহায়তায় তিনি গিটার বাজাতে শুরু করেন। গিটার বাজিয়ে জীবনের তার প্রথম উপার্জন ছিল ৩০ টাকা।
কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে একটা ব্যান্ডদল গঠন করেন। প্রথমে ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ‘গোল্ডেন বয়েজ’, পরে নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। বিয়েবাড়ি, জন্মদিন আর ছোটখাট নানা অনুষ্ঠানে এ ব্যান্ডদল নিয়ে গান করতেন আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরা যে যার মতো ছুটে গেলেও গানের পেছনে লেগে থাকেন আইয়ুব বাচ্চু। এর মধ্যে ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের হয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে গান শুরু করেন তিনি।
Advertisement
সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের অলিগলিতে রাতের পর রাত আমি গিটার হাতে বেড়িয়েছি। কাঁধে গিটার নিয়ে বিয়ে বাড়িতে হাজির হয়েছি। গিটার বাজিয়েছি। চট্টগ্রাম আমার নাড়ি পোঁতা শহর। এ শহরে আমার মা ঘুমিয়ে আছেন। এ শহরেই আমি আবারও ফিরে আসব।’
আইয়ুব বাচ্চু যখন গানের পেছনে ছুটছেন, ততদিনে মোটামুটি চট্টগ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ‘সোলস’। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে সোলস-এ যোগ দেন বাংলা ব্যান্ডের ‘ক্ষ্যাপা’ তরুণ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাওয়া আইয়ুব বাচ্চু। শুরু হলো বাংলার সর্বকালের সেরা একটি ব্যান্ড দলের যাত্রা- যেখান থেকে বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের আকাশে স্বমহিমায় ঠাঁই করে নিয়েছে একটি নক্ষত্র হিসেবে। সেই তরুণ তুর্কি আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে ব্যান্ডের গিটারিস্ট, ভোকাল, গীতিকার ও সুরকার।
কতটা গান পাগল মানুষ ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু তার প্রমাণ মেলে একটি ঘটনায়, এল আর বি’র ফেসবুক পেজে সেই ঘটনার বর্ণনা দেয়া আছে এভাবে, ‘১৯৯১ সালের এক ফাগুনের দিনে ‘সোলস’ এর গিটারিস্ট সুহাসের চট্টগ্রাম হিল বর্তমান ফরেস্ট কলোনির এলাকার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সবাই। সঙ্গে ছিলেন গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গি। সেখানে যাওয়ার পর সবাই মিলে আশপাশের পাহাড় অরণ্য ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আইয়ুব বাচ্চু যেখানেই ঘুরে বেড়াতে যেতেন সঙ্গে থাকতো গিটার। সবাই যখন মুগ্ধ প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত তখন আইয়ুব বাচ্চু গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গিকে প্রস্তাব দিলেন ‘জঙ্গি ভাই এমন সুন্দর পরিবেশে গান ছাড়া কি চলে? চলুন আমরা কোনো গান তোলার চেষ্টা করি’।
আইয়ুব বাচ্চুর প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গি লিখেন...‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে/মায়াবী সন্ধ্যায় চাঁদজাগা একরাতে/একটি কিশোর ছেলে, একাকী স্বপ্ন দেখে/হাসি আর গানে সুখের ছবি আঁকে/আহা কি যে সুখ।’
Advertisement
সেই ঘুমভাঙা শহরে কিশোর ছেলের স্বপ্নের পেছনেই সারা জীবন ছুটে চলেছেন আইয়ুব বাচ্চু। নিজের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্যান্ড দল ‘ইয়োলো রিভার ব্যান্ড’। কিন্তু বিদেশের এক প্রোগ্রামে গিয়ে দেখেন ভুল করে তার দলের নাম লেখা হয়েছে ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। কিন্তু নামটি আইয়ুব বাচ্চুর ভালো লেগে যায়, তাই নিজ দলের নাম বদলে রাখেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে জানা যায় ওই নামে অস্ট্রেলিয়ান একটি ব্যান্ড আছে। তাই আবারও নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’ বা এল আর বি।
‘এল আর বি’ প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এল আর বি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এ অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৩ ও ৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম ‘সুখ’ এবং ‘তবুও’ বের হয়।
১৯৯৫ সালে বের হয় আইয়ুব বাচ্চুর সর্বকালের সেরা একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এ অ্যালবামের ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ও ‘আমিও মানুষ’ গানগুলো তুমুল জনপ্রিতা পায়। ২০০৮ সালে বের হয়েছিল সর্বশেষ অ্যালবাম ‘স্পর্শ’।
তবে জীবনের শেষ দিকে দেশের অডিও বাজার নিয়ে বেশ হতাশ ছিলেন খ্যাতিমান এ সঙ্গীত শিল্পী। চট্টগ্রামের ছেলেটি চট্টগ্রামের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। চট্টগ্রামের তরুণ শিল্পী এবং ব্যান্ড সংগীতে আগ্রহীদের জন্য ‘এবি লাউঞ্জ’ নামে নতুন একটি প্লাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীত ও শিল্প চর্চার জন্য একটি মিউজিক্যাল একাডেমি করার ইচ্ছা ছিল তার।
গত ২৪ আগস্ট আইয়ুব বাচ্চু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি চট্টগ্রামের সন্তান। তাই চট্টগ্রামের জন্য কিছু করে যেতে চাই। আমি সারাজীবন গাইতে পারব না। কিন্তু আমি চাই চট্টগ্রাম থেকে আমার মতো আরও কেউ উঠে আসুক। চট্টগ্রামের উদীয়মান শিল্পীদের জন্য আমি একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই। চট্টগ্রামে এবি লাউঞ্জ হবে ব্যান্ড সংগীত এবং উদীয়মান ব্যান্ড শিল্পীদের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার।’
যে মানুষটি চলে গেলেন সবাইকে অবাক করে দিয়ে। তাও তিনি বলে গেছেন গানের মাঝে দিয়ে। অনেক আগে লিখে গেছেন রুপালি গিটার ফেলে চলে যাওয়ার গল্প। নব্বইয়ের দশকের সেই কিশোর-তরুণদের মনে আজীবন বেজে যাবে সেই অমিয় সুর...‘এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে/সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো/গোপন করে....।’
আবু আজাদ/এএইচ/জেআইএম