প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় তারা সিকি-আধুলি, চালচুলাহীন। রাজনীতির মাঠে ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নীধিরাম সর্দার। মরা গাঙে গিয়ে চিটাযুক্ত ধানের শীষ ধরেছেন। ঐক্যের নামে সব চোর আর ঘুষখোর একত্রিত হয়েছে- এমন মন্তব্যও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। রতনে রতন চেনে শিয়ালে চেনে কচু- এই শ্লোকও শুনিয়েছেন। তাদের নিয়ে স্বরচিত ছড়াও শুনিয়েছেন শেখ হাসিনা।
Advertisement
অন্যদিকে, দলীয় প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়া জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। মন্তব্য আর প্রতিক্রিয়ার অর্থটা কি দাঁড়ালো? চোর-ঘুষখোররা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিললে সেটা হবে জাতীয় ঐক্য? তখন আর চোচরা-ধুতুরা পাতার সঙ্গে তুলসী পাতার অমিল থাকবে না?
আসলে নির্বাচনের আগেই জমে উঠেছে ক্ষমতার খেলা। বেশ জম্পেস এ আগাম খেলায় দর্শকের চেয়ে যেন খেলোয়াড়ই বেশি। কেউ কারে নাহি ছাড়ে প্রতিযোগিতা খেলারামদের মধ্যে। গালমন্দ আর যাচ্ছে তাই মন্তব্য ছোঁড়ার সার্কাসও জমেছে। একদল ড. কামাল হোসেন, রব, মান্নাকে রাম ধোলাই দিচ্ছে। আরেক দল হোয়াইট ওয়াশ করছে বাপ-বেটা ডা. অধ্যাপক এ কিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মাহি বি. চৌধুরীকে। ক্ষমতার এ খেলার আগে, ভোটের আগাম ফলাফল জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। রাজনীতির বাজারে সব প্রতিপক্ষকে ঘাবড়ে দেয়ার মতো তথ্য। জানিয়েছেন, দেশের এবং জনগণের উন্নয়ন করায় আওয়ামী লীগের ভোট বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে।
এ তথ্যের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা রয়েছে বলেও দাবি তার। ইমামের দেয়া ভোটের অংক খুৎবার মতো আলোচিত। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জন্য এটি প্রণোদনার। উৎসাহের। অবশ্য বিরোধীমত থেকে এইচটি ইমামের তথ্য নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। বিরোধীমতের প্রধান দল বিএনপি চলছে নেতৃত্বশূন্যতায়। দলের প্রধান কারাবন্দি। দ্বিতীয়জন দেশান্তরি। বাকিদের সবাই মামলায় ধরাশায়ী। দলটির রাজনৈতিক সংসার চলছে ঐক্যফ্রন্টকে ঘিরে। সঙ্গী হয়ে রয়েছে জামায়াতও।
Advertisement
এ অবস্থায় ভোটের অংক নিয়ে বাহাসের সময় না থাকলেও ক্ষমতার খেলায় পিছিয়ে নেই বিএনপি। এছাড়া শত্রুর শত্রুদের বন্ধু করতে পারার তৃপ্তির ঢেঁকুরও রয়েছে দলটির। একই সুখ রয়েছে সরকারেরও। বি. চৌধুরীরা বিএনপি ও ড. কামালদের প্রতিপক্ষ হওয়া প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগেরই বন্ধু।
ক্ষমতা ও রাজনীতির এ খেলায় শত্রু-মিত্র আপেক্ষিক। রাজনীতিতে আসলেই স্থায়ী শত্রু-মিত্র নেই। কিন্তু মানুষকে ঘোরে ফেলে স্থায়ী শত্রুতায় ফেলা হচ্ছে বছরের পর বছর। অবশ্য মানুষও ভুলে যায়। রাজনীতিকদের এটা একটা বড় সুযোগ। বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিকভাবে হত্যার উদ্যোক্তা, বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী খুনে লাল হওয়া জাসদকে কবেই বন্ধু এবং ক্ষমতার পার্টনার করেছেন শেখ হাসিনা।
স্বৈরাচার খ্যাত এরশাদ তো রয়েছেনই। ড. কামাল, মোস্তফা মহসিন মন্টুর মতো নেতারা এখন আওয়ামী লীগের শত্রু। বিএনপির বন্ধু। বছর কয়েক আগেও যারা শেখ হাসিনা হেফাজতি হয়ে যাচ্ছেন বলে সমালোচনা করেছিলেন তারা এরইমধ্যে মূর্খ বনে গেছেন। তেঁতুল হুজুর নামে গালমন্দ হজম করা আল্লামা শফিই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন।
শত্রু-মিত্রের এ খেলায় আপদ-বিপদও একাকার। ক্ষমতার অংক মেলাতে গিয়ে দুদিন আগেও যাকে বিপদ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই শক্তিকে অনিবার্য আপদের মতো সঙ্গী করা হচ্ছে। সঙ্গে আবার বাম-আধা বামরাও রয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এটার নাম দিয়েছেন মিনিমাম পয়েন্টের ইউনিটি। এমন মিনিমামের বিপরীতে ম্যাক্সিমাম ম্যাচে নেমেছে বিএনপি। শত্রু-মিত্র, আপদ-বিপদে ঠাসা এ ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার বাজার বেশ চাঙ্গা।
Advertisement
২০-দলীয় জোট অটুট রেখে এবং এই জোটের নেতৃত্বে থেকেই বিএনপি মিশেছে ঐক্যফ্রন্টে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, নির্বাচনী দাবি আদায়ে সরকারের বিরুদ্ধে অভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচি পালন করবে এই ফ্রন্ট। নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীকে ২০-দলীয় জোটের শরিক রাখা-না রাখার বিষয়টিকে ততো গুরুত্ব দিতে চায় না তারা। বাকিরা এতে রাজি হয়েছেন। জামায়াতের সঙ্গ ছাড়া নিয়ে যুক্তফ্রন্ট যে শর্ত দিয়েছিল, সেখানে দলটি অনড় থাকলে ঐক্য প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারত। কারণ বিএনপি ভোটের অঙ্কের হিসাব কষে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামতে চায়।
বিএপির সঙ্গে ফ্রন্ট নেতাদের শঙ্কা, জামায়াতকে অবহেলা করলে তারা অন্য কোনো দল বা জোটে মিলে যেতে পারে। চাবানো-চিবানো কথামালায় আওয়ামী লীগও হেফাজতের মতো ও জামায়াতকে সঙ্গী করে ফেলতে পারে। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের মিলমিশ জায়েজও হয়ে গেছে। জামায়াতকে নিয়েও সরকারের দিক থেকে এমন একটি তৎপরতার খবর জানেন বিএনপিসহ ফ্রন্ট নেতারা।
একইভাবে বি. চৌধুরী ও তার ছেলে মাহীর ব্যাপারেও পর্যাপ্ত তথ্য পেয়েছেন তারা। সরকারের শীষপর্যায়ে বাপ-বেটার বিশেষ যোগাযোগ, ব্যবসা-পাতির তথ্য বাজারেও আলোচিত। তাই আগে-ভাগেই বিপদ বিদায় করা হয়েছে। তবে, ফ্রন্টে না থাকার বিষয়ে বাপ-ছেলের বক্তব্য ভিন্ন। তা পরস্পরবিরোধীও। প্রথমে বলেছেন, তাদের রাখা হয়নি। বি. চৌধুরীকে দাওয়াত করে নিয়ে অপমান করা হয়েছে। ড. কামাল দরজাই খোলেননি। পরে বলেছেন, ফ্রন্টে রাষ্ট্রীয় কন্সপারেসি রয়েছে। পেছনে রয়েছে জামায়াত। তাই তারা ঐক্যে থাকেননি।
কী দাঁড়ালো অর্থটা? কথা আগেরটা ঠিক? না, পরেরটা? রয়েছে আরো কিছু প্রশ্নও। বি. চৌধুরী এতো আদর্শিক কি আগে কখনো হয়েছেন? তার রাজনৈতিক জীবনের একটা বড়ো অংশই জামায়াত গোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থানের। রাজনীতিতে জামায়াত যখন পুনর্বাসিত হয় তখন মরহুম জিয়ার আমল। তখন তিনি এই বিএনপি প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। কখনো জামায়াতের বিরোধিতা করেননি। চারদলীয় জোটের জামায়াত ছিলো অন্যতম শরীক।
আওয়ামী লীগের পতন ঘটাতে অনেক সভা সমাবেশ আন্দোলনে তাদের সাথেই ছিলেন বি. চৌধুরী। এরপর জোট সরকারের সময় তিনি রাষ্ট্রপতি। খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় জামায়াতের দুই মন্ত্রী। অভিভাবক হিসেবে তিনি কখনো তাদের বাদ দিতে প্রভাব খাটিয়েছেন এমন ইতিহাস নেই। আবার আওয়ামী লীগ আমলে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি হলে সেই রায়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন এমন বক্তব্য বিবৃতিও দেননি।
তিনি এখনো বিএনপিতে থাকলে, বিএনপি এখনো ক্ষমতায় থাকলে বা বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত থাকলে কি ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলতেন তিনি? বলতে পারতেন এককভাবে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া যাবে না? এখন বিএনপির গুরুচরণ দশা বলেই কি এমন কথা? এটা কারো বিপদের সুযোগ নেয়া হলো না?
বিএনপি থেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সন্মান তিনি পেয়েছেন। আবার হারিয়েছেনও। বা বিএনপি তা কেড়ে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাথে তিনি মহাজোটের হয়ে আগেও ভিড়েছিলেন। এবার সেটা দ্বিতীয়দফায় হলে তার আমছালা দুটাই গেলে খুশি হবার বহু লোক দেশে রয়েছেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সাথে নিয়ে বড়ো আকারে কোন জোট বা দল টেকসই হয়নি।
২০০১ সালে বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকার সময় রাষ্ট্রপতি থেকে তিনি অপসারিত হয়েছিলেন। পরে তিনি গঠন করেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশ। জোট সরকারের শেষ সময়ে কর্নেল ( অব.) অলি আহমেদও দল থেকে বের হয়ে এলডিপি গঠন করেছিলেন। পরে দু’জনে একীভূত হয়ে এলডিপি গঠন করলেও তার স্থায়িত্ব বেশি দিন হয়নি। বি চৌধুরী আবার তাজা করেন বিকল্পধারা। আর এবার জোট গঠনের আগেই আপদের মতো তাড়ানো হলো তাকে।
প্রশ্নবানে ড. কামালের অবস্থাও এমনই। অল্প ভয়ে বিড়াল গাছে ওঠে না বলে বাঙালি সমাজে একটা প্রবাদ চালু রয়েছে। এর কার্যকরিতা ও উদ্ধৃতি দিয়ে অনেকে বলছেন, শেখ হাসিনাও কম দুঃখে ড. কামাল, রব, মান্নাদের নিয়ে ব্যঙ্গ, ছড়া আবৃত্তি করছেন না। তিনি তাদের হাড়ে হাড়ে চেনেন। জানেন। রাজনীতির অংক ও সমীকরণে, জোটবাজিতে তারা তার পার্টনার ছিলেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে এরশাদ, ড. কামালের সঙ্গে মহাজোটেও শরীক হন বি. চৌধুরী। মঞ্চের শোভা শেষে শুধু এরশাদকে রেখে ড. কামাল, বি. চৌধুরী, কর্নেল অলীদের অনেকটা ছুঁড়েই ফেলা হয়। আসম রবকেও শেখ হাসিনার ভালো চেনা। জানা-চেনার পর রবকে তিনি ৯৬-তে ঐকমত্যের মন্ত্রী করেছিলেন। সেইসূত্রে তাদের স্বভাব, বৈশিষ্ট্য, দোষ-গুণ, ওজন, দৌড় সবই শেখ হাসিনার মুখস্থ। শেখ হাসিনাকে ৮১-তে দেশে ফিরিয়ে আনতে অন্যতম ভূমিকা রাখা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার বোঝাপড়া ও কৃতজ্ঞতা ছিল অনেকের কাছে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। নানা ঘটনায় পরে তাদের মধ্যে বনিবনায় সমস্যা দেখা দেয়।
ঐক্য প্রক্রিয়ার তারকা নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ-বাসদ করে পরে আওয়ামী লীগে ভিড়েছিলেন। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদকও করা হয়েছিল তাকে। আমু, তোফায়েল, রাজ্জাকসহ অনেকে দলে ঠাঁই করে নিতে পারলেও সংস্কারপন্থী সিলটা মান্নার গায়ে বেশি লেপ্টে যায়। এতে তার আর আওয়ামী লীগে ফেরা হয়নি। জাতীয় ঐক্যের আরেক ধারক ও ডাক্তার জাফরউল্লাহ চৌধুরীও শেখ হাসিনার বেশ চেনাজানা। এই জোটের হিতাকাঙ্খী অন্য ডক্টররাও শেখ হাসিনার জানার বাইরে নন।
ভোটের রাজনীতিতে না হলেও ক্ষমতার খেলায় তারা ম্যাটার করেন। তা-ও সহযোগী বা নেপথ্য কুশীলব-আয়োজক হিসেবে। কারো না কারো ভাগেই পড়তে হয় তাদের। অ্যারেঞ্জ করা ক্ষমতা ভোগের ভাগীদার হওয়া তাদের ভাগ্যে জোটে না। এই মহারথীরা ভোট ও এলাকার কর্তৃত্বের প্রশ্নে লুটেরা, ব্যাংকখাদক, মাদক ও চোরাকারবারীদের চেয়ে অনেক কমজুরি। মুখে মুখে বা গণমাধ্যমে নিন্দিতদেরই মানুষ কাছে বেশি পায়। কম-বেশি সুযোগ-সুবিধা মেলে। কিন্তু ড. কামাল, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, রব-মান্নারা এক্ষেত্রে নিস্ফলা। বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় থাকার সময়ও তারা আমজনতার পাশে দাঁড়াননি।
বদি, জাহাঙ্গীর বা মহীউদ্দীন খান আলমগীরদের মতো কিছু দেয়া-নেয়া করেননি। এর বিপরীতে উল্টাকথাও রয়েছে। ব্যাংক লুটেরা, ইয়াবাবাজ ও দুর্নীতির মহামানবদের ঘটনাচক্রে কোনোভাবে আইনের আওতায় আনা হলে এই ড. কামাল, মতিন খসরুরা কালো কোর্ট পরে নেমে পড়েন তাদেরকে খালাসের চেষ্টায়। সেখানে আদর্শ, শত্রু-মিত্র, আপদ-বিপদের কোনো ব্যাপার থাকে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস