অর্থনীতি

বাড়বে তারল্য, ফিরবে কি আস্থা?

>> পুঁজিবাজারে ২ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়বে আইসিবি>> ৭৫ শতাংশ অর্থ বাজারে বিনিয়োগের নির্দেশ বিএসইসির>> নির্বাচনের কারণে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে কেউ কেউ>> গুজবে বিনিয়োগ না করতে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

Advertisement

দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড ছেড়ে তার কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-কে ২সিসি ক্ষমতাবলে বাধ্যতামূলক নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। 

আস্থার সংকটে ভুগতে থাকা পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ সিদ্ধান্ত তারল্য বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। এতে কিছুটা হলেও বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছুদিন ধরে দেশের পুঁজিবাজারে মন্দাভাব বিরাজ করছে। এর প্রধান কারণ এ বছরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মতৈক্য বিরাজ করছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে কী হবে- তা নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। এতে বিনিয়োগ নিয়ে আস্থার সংকটে ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। 

Advertisement

তারা বলছেন, বাজারের এ পরিস্থিতিতে আইসিবির বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আনার সিদ্ধান্ত খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে আইসিবির এ বিনিয়োগ অবশ্যই ভালো শেয়ারে হতে হবে। ফান্ডামেন্টাল বা মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ারে বিনিয়োগ না করে, আইসিবি যদি দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে তাহলে বাজারে সাপোর্ট দেয়ার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। 

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে গত ১৭ জুলাই দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমোদন দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গত ১১ অক্টোবর বিএসইসির কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বন্ড বিক্রির কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ অর্থ আইসিবিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হব। 

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্সে ১৯৯৬’র ২সিসি ক্ষমতা বলে এ সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ সিদ্ধান্তের ফলে বন্ড বিক্রি করে আইসিবিকে কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। 

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউকে বলেন, ‘এটি খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। কারণ অনেক দিন ধরে বাজারে মন্দাভাব চলছে। এ পরিস্থিতিতে শেয়ারের চাহিদা বাড়ানো উচিত।’ 

Advertisement

তিনি বলেন, ‘সাধারণত বিএসইসি আইসিবিকে মার্কেট স্থিতিশীলের ভূমিকায় সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করে। আমি বিএসইসির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়ও এটা করার চেষ্টা করেছি। এখন আইসিবি যদি টাকাটা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে, তাহলে সূচক বাড়বে। আর সূচক বাড়লে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ বাড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইসিবির বন্ডে কোনো ব্যাংক বিনিয়োগ করলে তা পুঁজিবাজার বিনিয়োগ সীমার বাইরে থাকবে- বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটিও বাজারে তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ। তবে একটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, আইসিবি যেন পঁচা শেয়ারে বিনিয়োগ না করে। আইসিবিকে অবশ্যই ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে।’ 

এদিকে নির্বাচনী বছর হওয়ার কারণে কয়েক মাস ধরে বাজারে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে- এমন গুঞ্জন রয়েছে। কিছু কিছু ব্রোকারেজ হাউজ থেকে বিনিয়োগকারীদের নতুন করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। 

পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামী নিজেও এমন গুঞ্জন ছড়ানোর কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, এ বছরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কেন্দ্র করে গ্যাঞ্জাম হবে, ফ্যাসাদ হবে- হাউজে হাউজে এ ধরনের বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের এসব গুজবে কান দিতে কে বলেছে’- প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের শিক্ষিত হতে হবে। কোম্পানির তথ্য ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করতে হব। মনে রাখতে হবে, গুজবের বিনিয়োগে মুনাফা করা সম্ভব নয়। 

তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় থাকবে- এটা স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশে সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক চর্চা এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। আবার বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বড় ধরনের মতৈক্য দেখা যাচ্ছে। যে কারণে এখন বাজারে তারল্যের থেকে আস্থাটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। 

তারা বলছেন, বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়লে তারল্যের অভাব হবে না। এরপরও বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়িয়ে ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে তারল্য বাড়ানোর পাশাপাশি মনিটরিংও জোরদার করতে হবে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে কিনা- তা নজরদারির মধ্যে আনতে হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, ‘নির্বাচনী বছরে একটি অনিশ্চয়তা থাকবে- এটা স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতি যে কোনো ধরনের প্রণোদনা অন্য সময়ের তুলনায় কম ভূমিকা রাখে। তারপরও আইসিবির বিনিয়োগ যদি পুঁজিবাজারে আসে এবং সেই বিনিয়োগ দক্ষভাবে করতে পারলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে বিনিয়োগকারীদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, গুজবে বিনিয়োগ না করে বাজারে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। তাহলে পুঁজিবাজার থেকে ভালো মুনাফা করা সম্ভব।’ 

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই পুঁজিবাজারকে একটা ভালো স্থানে নিয়ে যেতে চাই। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। আইসিবির বড় অঙ্কের বিনিয়োগ বাজারে আনতে বিএসইসির নির্দেশনা তারই প্রতিফলন।’ 

বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, ‘গুজবে বিনিয়োগ করবেন না। বিনিয়োগের আগে অবশ্যই সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করতে হবে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ভালো করে পড়ে নিতে হবে। কোম্পানির পেছনে কারা আছেন সে বিষয়টিও বিনিয়োগকারীদের খতিয়ে দেখতে হবে।’ 

এমএএস/এমএআর/জেআইএম