বিবিধ

সেদিন যা ঘটেছিল

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। ভোর সাড়ে ৫টা দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করছে। ঠিক তখনই বাড়িটি লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমন শুরু হয়। তবে ধানমন্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই শেখ মুজিবুর রহমান আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর জেনে যান।গুলির শব্দ শুনেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘুম থেকে উঠে পড়ে গৃহকর্মী আব্দুল আর রমা। বেগম মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে  দেখেন সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে।  এরই মধ্যে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামতে থাকেন। দোতলায় বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। রমা তিন তলায় চলে আসে এবং বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পড়ে নিচতলায় নামের শেখ কামাল। সুলতানা কামাল আসেন দোতলায়। শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান। ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল (বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারি)। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জের চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি...।’ বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। একঝাঁক গুলি জানালা দিয়ে অফিসের ভিতরে এসে দেয়ালে লাগে। কাচের জানালা ভেদ করে গুলি এসে মুহিতুলের ডান হাতে লাগে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুঁইয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে নিচতলার ওই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কি করছো’। এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু ওপরে চলে যান। এরপর শেখ কামাল নিচে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’ এ সময় শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মুহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট নুরুল ইসলাম খান। ঠিক তখনই মেজর নূর মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সৈন্যদের নিয়ে বাড়িতে প্রবেশে করে। গেটের ভেতরে ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। এসময় কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ে যান শেখ কামাল। তখন মুহিতুলকে বলতে থাকেন ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলুন’। মুহিতুল তা বলার সঙ্গে সঙ্গেই বজলুল হুদা তার হাতে থাকা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। ওখানেই মারা যান শেখ কামাল। নিচে কি হচ্ছে তার কিছুটা টের পাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তার ঘরের দরজা বন্ধু করে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসায় অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন,“সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।”জবাবে সফিউল্লাহ বলেন “আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আইট অফ দ্য হাউজ?” এদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু সোবহানবাগ মসজিদের কাছে আসতেই ঘাতকরা জামিলকে হত্যা করে। এর কিছুক্ষণ পর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে আসে। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। এ সময় নিজ ঘরে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজি জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বাইরে আসা মাত্রই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। তখন ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন “তোরা কি চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?”বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি-বেয়াদবি করছিস কেন?” এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে আনার সময় নূর কিছু একটা বলতেই মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। নিথর দেহটা সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকে। রমার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে গুলির কথা শুনে বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের এবং গৃহকর্মীরা বাথরুমে আশ্রয় নেয়। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিচে নেমে এসে বেরিয়ে যায়। এরপরেই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন তাদের সৈন্যসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় চলে যান এবং ঘরের দরজায় গুলি করতে থাকে। পরে বেগম মুজিব দরজা খুলে তাদেরকে না মারার অনুরোধ করেন। ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসতে থাকে।সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই বেগম মুজিব চিৎকার করে বলেন,“ আমি যাবো না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।”বেগম মুজিব অস্বীকৃতি জানালে তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনেন। শেখ রাসেল, শেখ নাসের এবং রমাকে নিয়ে আসে। ওই ঘরেই বেগম মুজিব, শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতক আজিজ পাশা রিসালদার মোসলেউদ্দিন। শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করানো হয়। লাইন থেকে নিয়ে পাশের ঘরে বাথরুমে নিয়ে শেখ রাসেলকে হত্যা করে। লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসের প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুলকে জড়িয়ে ধরে বলে “ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?” এসময় শেখ রাসেল মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা মুহিতুলের কাছ থেকে জোর করে দোতলায় নিয়ে যেতে বলে। তখন এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে যায় এবং সেখানেই শেখ রাসেলকে হত্যা করে। গুলিতে রাসেলের চোখ বেরিয়ে আসে। মাথার পেছনের খুলি থেতলে যায়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর সেই প্রিয় বাড়িটি যেন রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। যেন গুলির শব্দ আর কামানের গর্জনে কেঁপে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।    সূত্র : তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং না বলা কিছু কথা : লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) আব্দুল হামিদ-পিএসসি  এএসএস/এআরএস

Advertisement