মতামত

মানসিক স্বাস্থ্য : দূর হোক নতুন প্রজন্মের ভুল ধারণা

দ্রুত পরিবর্তনশীল মহাবিশ্বে প্রতিনিয়তই টিকে থাকার লড়াই করে চলেছে প্রাণীকূল। এই বিশাল মহাজগতে আমরা একেকজন অতি ক্ষুদ্র প্রাণ। নানা প্রতিকূলতা আর সংগ্রামের পাশাপাশি যেখানে রয়েছে বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য, নতুনত্ব বা উৎকর্ষ; যা টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষের প্রধান অস্ত্র। জ্ঞান, বিবেক আর আত্ম-সচেতনতা সেই অস্ত্রকে শাণিত করে। তৈরি হয় জীবনের উন্নত অধ্যায়।

Advertisement

এ কারণেই একজন ব্যক্তির অপরিহার্য বিষয় তার মন, যা তাকে এই জগৎ সংসার ও তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে; অনুভব ও চিন্তা করতে সক্ষম করে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তীতে সে ক্রিয়াশীল হয়। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এই বিশ্ব।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে উপযুক্ত ব্যবহার জানার আগেই প্রযুক্তিকে হাতের মুঠোয় নেয়ার প্রবণতা। ফলে ক্ষয়িষ্ণু প্রবণ হয়ে উঠছে আমাদের তরুণ সমাজ। ভেঙে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধন, হারিয়ে যাচ্ছে মানবিকতা। তবে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার জানানো পূর্বসূরিদের দায়িত্ব।

মন হলো চিন্তার সত্ত্বা এবং সচেতনতার শক্তি। আর মানসিক স্বাস্থ্য হলো আমাদের চিন্তা, মন ও আবেগের সুস্থতা; শৃঙ্খলা ও সামর্থ্য। এটা এমন ভালো থাকা, যাতে একজন ব্যক্তি নিজের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারে; জীবনের স্বাভাবিক চাপ মোকাবেলা করে সাফল্যের সাথে সৃষ্টিশীল কাজ করে যেতে পারে এবং সামাজিক অঙ্গনে অবদান রাখতে পারে। মানসিক সুস্থতার সাথে একটি জীবনের সাফল্য এবং ব্যাপক অর্থে গোটা সমাজের ভালো-মন্দ জড়িত। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যই আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও কাজে প্রভাব রাখে।

Advertisement

দ্রুত বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাথে সাথে তরুণদের চিন্তা ভাবনা তথা সামাজিক ধ্যান ধারণাও পরিবর্তিত হয়। যেমন- কারো পোশাক দেখে আমরা অনেক কিছুই বিচার বিবেচনা করি। ছোট পোশাক পড়লে মেয়েরা খারাপ, আর ধর্মীয় পোশাক হলে সে আধুনিক নয় বা উগ্রপন্থি।

আবার গ্রাম ও শহরবাসীদের নিয়েও আমরা অনেক পার্থক্য করি। তবে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও পর্যবেক্ষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। যার মাধ্যমে তরুণদের সুন্দর মনের বিকাশ হবে। সমাজে বাড়বে শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব।

১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য "Young people and mental health in a changing world", অর্থাৎ পরিবর্তনশীল বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য। এই যুগেও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের সমাজে নানামুখী ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। যার সাথে বাস্তবের মিল নেই। অসচেতনতা আর না জানার কারণে আমাদের মনে গেঁথে যাওয়া ধারণা নিয়ে তাই খোলামেলা আলোচনা করা প্রয়োজন। যাতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বস্তুনিষ্ট ও প্রচ্ছন্ন ধারণা পেতে পারেন সবাই।

যেমন- অনেকেই মনে করেন, মানসিক সমস্যা নিজের দুর্বলতার কারণেই হয়। ওষুধ খেলেই হবে, সাইকোথেরাপির দরকার নেই। কিন্তু গবেষণা বলছে, বড় ধরনের শারীরিক রোগের মতোই মানসিক সমস্যার সবক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে দায়ী নয়। এর জন্যে অনেক ক্ষেত্রেই বংশগত ও পরিবেশগত কারণ দায়ী। এটা কোন ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়। এই সমস্যার চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যক্তিভেদে আলাদা হতে পারে। কারো ক্ষেত্রে কেবল ওষুধ, কারো ক্ষেত্রে মনোবৈজ্ঞানিক থেরাপি বা কাউন্সেলিং, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দু’টিই দরকার হতে পারে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবারের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

Advertisement

কেবল বাংলাদেশ নয়, আমাদের এই উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের ধারণা, মাথার রোগ বা সমস্যা কিছু না। জিন-ভূতের আছর পড়েছে। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার মতোই এক ধরনের অসুস্থতা। জিন-ভূতের আছর বলে বাস্তবে কিছু নেই। বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।

 অনেকে বলে থাকেন, মানসিক অসুস্থতা কিছুই না, এটা এক ধরনের ঢং। মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল। আসলে মানসিক সমস্যা কোন ঢং নয়। কেউই স্বেচ্ছায় অসুস্থ হতে চায় না। সেটা শারীরিক হোক বা মানসিক। মানসিক সমস্যার লক্ষণসমূহ একজন প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ কারো কাছে ধরা নাও দিতে পারে।

হয়তো ভাবছেন, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে ব্যক্তির ভবিষ্যত শেষ। কারণ এই সমস্যা কখনও ভালো হয় না। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা বলছে, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি ভালো হয়ে উঠতে পারেন এবং অনেকেই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেন। তাদের সারিয়ে তুলতে রয়েছে যথেষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেবা ও সহায়ক কার্যক্রম।

মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নেয়া ব্যক্তি খুব ভালোভাবে জীবন যাপন করতে এবং পূর্ণ উদ্যোমে সমাজে অবদান রাখতে পারেন। এমনকি যাদের মানসিক সমস্যা নেই, অনেক ক্ষেত্রে তাদের চেয়েও তারা কাজের দক্ষতা বেশি দেখাতে পারেন।

অনেকের ধারণা, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি আক্রমণাত্মক। যে কোন সময় তারা হামলা করতে পারে। কিন্তু মানসিক সমস্যাগ্রস্ত অধিকাংশ মানুষ কোনভাবেই অন্যদের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক বা সহিংস নয়। মাত্র তিন থেকে পাঁচ শতাংশ ভয়াবহ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি আগ্রাসী কাজ করে ফেলতে পারেন। বাস্তবে সাধারণ মানুষের তুলনায় দশ গুণ বেশি সহিংসতার শিকার হয় মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি।

আমাদের বিশ্বাস যে, মানসিক সমস্যা সবার হয় না। খুব সামান্য মানুষেরই হয়। বাচ্চা ও অল্প বয়স্কদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয় না। কারণ তারা খুব সহজেই মনের কথা খুলে বলতে পারে। বাস্তবতা হলো মন বা মানসিক স্বাস্থ্য সবারই রয়েছে। যা কখনও কখনও সমস্যাগ্রস্ত হতে পারে। ঠিক যেভাবে মাঝে মধ্যে আমাদের শরীর অসুস্থ হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি চারজনের একজন জীবনের কোন না কোন সময়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ শতাংশের বেশি শিশু-কিশোর মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। আরেক গবেষণা তথ্য হচ্ছে, প্রতি চারজন শিশু-কিশোরের মধ্যে প্রায় তিনজনই তাদের অনুভূতি নিয়ে বন্ধুদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে উদ্বিঘ্ন।

অনেকে মনে করেন, বাবা-মায়ের দোষেই সন্তানদের মানসিক সমস্যা হয়। যে সব বাবা-মা ঠিক মতো লালন-পালন করতে পারেন না, তাদের সন্তানরাই বেশি মানসিক সমস্যায় পড়ে। কিন্তু শিশুর মানসিক সমস্যা বংশগত বা শারীরিক কারণেও হতে পারে। যেমন- গর্ভকালীন জটিলতা। অপমানজনক ও অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ এবং প্রচণ্ড মানসিক চাপের শিকার শিশুর মধ্যেও এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আমরা মনে করি, মন খারাপ কোন বিষণ্ণতা রোগ নয়। তবে অনেক সময় বিষণ্ণতার লক্ষণ হতে পারে মন খারাপ। দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক পরিবার মনে করে, বিয়ে দিলে মানসিক সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। বাস্তবতা হলো বিয়ে কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। বরং এতে সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। মানসিক সমস্যা কেবল চিকিৎসার মাধ্যমেই ভালো হয়।

অনেকের ধারণা, মনোবিজ্ঞানীরা চেহারা দেখেই বলে দিতে পারেন সবকিছু। ব্যক্তি কী চিন্তা করছে, এমনকি পরিচয়ও বলতে পারেন। ভবিষ্যত সম্পর্কেও আগাম ধারণা দিতে পারেন। আসলে মনোবিজ্ঞান হলো চিন্তার প্রক্রিয়া ও আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান। যে বিষয়ে সাধারণত মানুষের আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া সমূহের বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়।

এখানে চেহারা দেখে বলার কিছু নেই। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে কোন পরামর্শ বা ভবিষ্যত নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন মনোবিজ্ঞানী বা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও আপডেটেড মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন।

লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, আমেরিকা বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটাল, মালিবাগ, ঢাকা।

 nznury@yahoo.com

এইচআর/আরআইপি