মতামত

ফাঁকা মাঠে ফাউল গেম

মহামান্য রাষ্ট্রপতির সইয়ের মধ্য দিয়ে কার্যকর হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সইয়ের পরই তা আইনে পরিণত হলো। নানান অনুনয়-বিনয়ের পর সাংবাদিকদের আবদার ছিল রাষ্ট্রপতি যেন এতে সই না করেন। সেই প্রহরও শেষ। আইন শিরোধার্য। তা অমান্য-অগ্রাহ্য করা মানেই অপরাধী। গুরুতর যতো শাস্তির এন্তেজাম।

Advertisement

সব মত-পথের সাংবাদিকরা বুঝে ফেলেছেন অবস্থাটা। অবশ্য সেটা তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তিনি আইনটির পক্ষে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন।

নির্বাচনের আগে এমন একটি আইন কেন সরকারের জন্য এতো জরুরি হয়ে গেল- এ নিয়ে প্রশ্ন, জবাব, শঙ্কা, ধারণা অন্তহীন। নির্বাচনের আগে পরিবহন শ্রমিকরাও আবার রাস্তা গরম করা জরুরি মনে করেছেন। ধুম-ধারাক্কা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন তারা।

সদ্য পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের গত ক’দিনের তৎপরতা মোটেই শুভলক্ষণ নয়। ঢাকা বিভাগের ১৭টি জেলায় সব ধরনের পণ্য পরিবহন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন পরিবহন শ্রমিকেরা। ১২ অক্টোবরের মধ্যে আইন সংশোধন করা না হলে পরিবহন ধর্মঘটসহ বৃহত্তর কর্মসূচির হুমকি-ধমকি দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।

Advertisement

মাঠে অ্যাকটিভ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাও। তাদের সঙ্গে শামিল হয়েছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরাও। হাতে গোনা জনাকয়েকের অবস্থান কর্মসূচি শাহবাগ এলাকায় স্থায়ী জট তৈরি করেছে। বিএনপি বা বিরোধীমত উপরোক্ত আন্দোলনের পার্ট নয়। কম-বেশি তারা সরকারের কাছাকাছি শক্তি।

এসবের কোনো কোনো মহলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক সুমধুর। বিশেষ করে সাংবাদিক মহল ও পরিবহন সেক্টর সরকারের নিরঙ্কুশ আয়ত্বে। সেখানে অপজিশনের তেমন পজিশন নেই বললেই চলে। এরপরও বিষয়টা কেমন হয়ে গেলো না? এসব সেক্টরের ভেতর-বাইরের আয়োজক ও রাজনীতি নিয়ে শোনা কথাগুলো অমূলক- অসত্য হলেই ভালো।

সরকারের শঙ্কা নির্বাচনের আগে, গণমাধ্যমে কিছু বিব্রতকর খবর আসতে পারে। গুজবও ডালপালা ছড়াতে পারে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও সেই ইঙ্গিত রয়েছে। সবকালের ক্ষমতাসীনরাই এমন শঙ্কায় ভোগে বিশেষ বিশেষ সময়ে। বিশেষ করে মেয়াদের শেষ সময়ে। এর উল্টো বাস্তবতা হচ্ছে আইনের প্যাঁচে বা ধমকিয়ে তথ্য আটকানো যায় না। বরং তাতে তথ্য আরো ছড়ে। গুজবও বেশি রটে। সেই গুজব আবার সত্যও হয়ে যায়। ইতিহাস তার সাক্ষী।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে আইন দিয়ে কি সব আওয়াজ রোখা গেছে? দমনে থেমেছে কণ্ঠস্বর? এক কথায় উত্তর- না, যায়নি। যারা তা হাঁ করার আয়োজন করেন তারা হারেন। কখনো কখনো নিজেদের করা আইনে নিজেও ফাঁসেন। কথা বলা মানুষের স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য। কোনো কোনো মানুষ তা অকারণেও বলে। আপন মনে পর্যবেক্ষণ ও মতামত রচনা করে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির সমালোচনা করতেও ছাড়ে না।

Advertisement

সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক তা অন্যদেরও বিশ্বাস করাতে চায়। বাধ সাধলে তা আরো বেশি করে। মনগড়া তথ্যও রটায়। সেই তথ্যের জন্য এখনকার যুগে গণমাধ্যমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের ওপরও ভর করতে হয় না। পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতেও এখন বার্তাবাহক ও প্রচারকের কমতি নেই। এরা নিজেরাই একেকটা আস্ত বিবিসি, ভোয়া, সিএনএন। এরা তথ্যের সঙ্গে নানা গুজবও ফেরি করে।

শুধু রাজনৈতিক অঙ্গন নয়, এ নিয়ে সামাজিক-ব্যবসায়িক জগতেও অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে। সুফলভোগীর কাছে গুজব একটা তথ্য। আর আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্তের কাছে বানোয়াট, ভুয়া ইত্যাদি। তা দেখার বা শোনার সময় অন্যদের থাকে না। ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে যাচ্ছে।

সাংবাদিকরাও এ সমাজেরই অংশ। জাতে মানুষ। আইনের ভয়ে এই সম্প্রদায় একযোগে চানাচুরের গল্প করবে, বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন নিয়ে রচনা লিখবে, কেবল ফুল, পাখি, লতা, পাতার ফিচার করবে- মুখস্থ তা বলা যায় না। অতি স্তুতি-বন্দনা করতে গিয়েও ল্যাঠা লাগিয়ে দেওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বক্তৃতা বা প্রেসনোট দিয়ে সব হয় না। মানুষ রাজনীতিকদের সত্য কথাও সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। হয়তো রাজনীতিকরা নিজেরাও সেটা জানেন বলেই জোরে জোরে বলেন। বার বার বলেন। তাদের বক্তৃতা যে কেউ শুনছে না- সেইটা আড়াল করতেও তারা চেচিয়ে চেচিয়ে বক্তৃতা করেন। যে প্রবণতা আমাদের ওয়াজ করা আলেমদের কারো কারো মধ্যেও রয়েছে। বেহুদাও বিকট চেঁচিয়ে ওয়াজ ফরমান তারা। এক কথা বারবার শোনান তালে তালে। সুরে সুরে। গলা ফাটিয়ে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার এ চেষ্টা লাগসই হলে এই জমিনের হালদশা কবেই পাল্টে যেত।

এমন সময়ে কি বুঝে অনেকটা আচমকা মাঠে নেমেছেন পরিবহন জগতের মালিক-শ্রমিকরাও। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোমর বেঁধে রাস্তায় নামে পরিবহন শ্রমিকেরা। যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় রাজধানীর দুই প্রান্ত যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায়।

পশ্চিম দোলাইরপাড় এলাকায় চালায় আকস্মিক অ্যাকশন। সড়কে পণ্যবাহী পিকআপ-ট্রাক এলোপাথাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারদের লাইসেন্স পরীক্ষা শুরু করে। লাইসেন্স না থাকলে চালকদের মুখে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল মেখে দেওয়া হয়। গাজীপুরসহ আরো কয়েক জায়গায় ঘটায় একই ধরনের ঘটনা।

সড়ক-মহাসড়কে এরা রাজা-মহারাজ। এ টাইপের বাহাদুরির হেকমত তারা বরাবরই রাখে। গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।

তাদের আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সড়ক পরিবহন বিল পাস করা হয়। নতুন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় অপরাধ প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে দোষী চালকের সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আইনে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ারও বিধান আছে। সে ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।

তখন তারা বিষয়টি চেপে যায়। বোঝাই যাচ্ছে জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের কৌশলের জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। তাদের এ বাহাদুরির অপক্রিয়ায় জের পড়েছে কাঁচাবাজার, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সড়কে মানুষের ভোগান্তির সঙ্গে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকলে তার প্রভাব পড়বে জেনে-বুঝেই নেমেছে তারা। জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকার ধারাবাহিকতাতেই তাদের স্পর্ধা এ মাত্রায় এসে ঠেকেছে।

সেক্টর বা ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও তারা সবাই ক্ষমতাসীন ঘরানার। এর বাইরে শাহাবাগে খুচরা হাওলাতে চলছে কোটাবাদীদের শো-ডাউন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫ শতাংশ হক চায় প্রতিবন্ধীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তাদের পাশেই রয়েছে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামে আরেকটি সংগঠন। হাতে গোনা কিছু লোকের হাম্বিতাম্বিতে সেখানে অচলাবস্থা। মানুষ বিরক্ত।

এদের পেছনে আস্কারার নমুনা গোপন নেই। সরকারই মহলে এসব নিয়ে নিরন্তর খেলাধুলার তথ্য ভাসছে। ফাঁকা মাঠে এতো খেলায় ফাউলও কিন্তু কম হচ্ছে না। বেশি খেলায় ফাউলও বেশিই হয়। বেশি বেশি উইন্ডো খুলে বার বার মিনিমাইজ করার পরিণতি কম্পিউটার ব্যবহারকারী মাত্রই জানেন। এক সময় গোটা কম্পিউটারটাই হ্যাঙ হয়ে যায়। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রি-স্টাটেও কাজ হয় না।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর