ক্যাম্পাস

৪৪ বছর ধরে ঢাবি শিক্ষার্থীদের সনদ লেখেন তিনি

নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি। কিন্তু পড়িয়েছেন তিন কন্যাকে। তাদের সনদও লিখেছেন নিজ হস্তে। বাবা হিসেবে জীবনে হয়তো তার এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। বললেনও তাই, ‘হয়তো আমি সফল। কারণ, আমি আমার তিন সন্তানকে দেশসেরা বিদ্যাপীঠে পড়াতে পেরেছি। বাবা হিসেবে নিজ হাতে লিখেছি তাদের সনদ। কারণ, আল্লাহ আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করেছেন।’

Advertisement

বলছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. খোরশেদ আলম ভূঁইয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন উপলক্ষে যার নাম আসে আলোচনায়। গত ৪৪ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সনদ লিখছেন তিনি। তার সনদ লেখার সংখ্যা প্রায় লাখ ছাড়িয়েছে। গেল ৫১তম সমাবর্তনেও লিখেছেন দুই হাজারের অধিক শিক্ষার্থীর সনদ।

পড়ালেখা করার সুযোগ পাননি তেমন। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাকে। নামতে হয় কাজের সন্ধানে। কিন্তু সুন্দর হাতের লেখা তাকে আজ ইতিহাসের অংশ করেছে। লেখার নান্দনিকতাকে তিনি তার ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তৈরি করেছেন নতুন নতুন ফন্ট। যেগুলো তাকে আরও বিশেষায়িত করেছে। সুন্দর হাতের লেখাকে যে পেশা হিসেবে নেয়া যায় তার উজ্জ্বল প্রমাণ তিনি।

সম্প্রতি নিজ বাসায় জাগো নিউজের মুখোমুখি হন মো. খোরশেদ আলম ভূঁইয়া। দীর্ঘ আলাপচারিতায় সুন্দর হাতের লেখা নিয়ে নিজের অনেক অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন। কীভাবে লেখা সুন্দর করা যায়, তার বিভিন্ন দিক নিয়ে বলেছেন।

Advertisement

কখন-কীভাবে সুন্দর হাতের লেখাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার চিন্তা আসে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে লেখা সুন্দর করার একটা ঝোঁক ছিল। সেই ঝোঁক থেকেই শুরু। আস্তে আস্তে সুন্দর করে লিখতাম। পোস্টারও লিখেছি, স্কুলজীবনে। কারণ, তখনকার সময় প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না, এমনকি বিজলি বাতির নামও গ্রামের মানুষ শোনেনি। তখনকার সময়কার আমি। তখন টাইপমেশিন একটা দুর্লভ জিনিস ছিল। প্রেসও ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থীরা সুন্দর লেখা খুঁজতেন, পোস্টার লিখে প্রচারণা করতেন। তেমন একজনের পোস্টার আমি লিখতাম। বাঁশের কঞ্চি কেটে কলম বানাতাম। প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের মতো একটা কালো ট্যাবলেট ছিল। যেটা পানিতে দিলে কালি হয়ে যেতো। সে কালিতে কলম ডুবিয়ে ডুবিয়ে পোস্টার লিখতাম। তাছাড়া স্কুলজীবনে আমার এক স্যার ছিলেন, যার নাম চুন্নু বিএসসি। তার লেখা অসম্ভব সুন্দর ছিল। ছবিও আঁকতে পারতেন। আমি তার থেকেই অনুপ্রাণিত হই।

কিন্তু আমি কোনো প্রাণীর ছবি আঁকতাম না। কারণ, এলাকায় একবার একটা মাহফিলে এর খারাপ দিক বর্ণনা করেছিলেন এক হুজুর। তবে বিভিন্ন রুমাল, বালিশের কাভার- সবকিছুতে ফুল আঁকতাম। তখন একটা আনন্দ পেতাম। তবে ১৯৭৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের পর মনে হলো আমার দ্বারা ভারী কোনো কাজ হবে না। তাই আমাকে এমন কিছু করতে হবে যে কাজটা আমাকে ভারী কাজ থেকে বাঁচাবে। কারণ, আমি তখন খুব হ্যাংলা-পাতলা ছিলাম। সেই থেকে ভাবলাম, লেখা সুন্দরের একটা ব্যাপার হতে পারে।

সুন্দর লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের ইতিহাস বলতে গিয়ে মো. খোরশেদ আলম ভূঁইয়া বলেন, ১৯৭৪ সালে ইলিয়াস স্যার নামে আমার আরেকজন স্যার ছিলেন। যিনি আমাকে কিছু টাকা দিয়ে রামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হতে বলেছিলেন। সেই টাকা দিয়ে ভর্তি হই। এরপর যখন কলেজে পড়ি, তখন লজিং থাকতাম। তখন এলাকায় বন্যা হয়েছিল। তারা (লজিং বাড়ি) আমাকে বললো, মাস্টার সাহেব কাঁচারিতে পানি উঠে গেছে, আপনি কিছুদিন বাড়িতে থেকে আসেন। তখন আমি বাড়ি এসে দেখি খুব অভাব। মা একা বাড়িতে। বড় ভাই ঢাকার কমলাপুর রেলওয়েতে কাজ করছিলেন তখন। মা বলেন, চল আমরা ঢাকায় তোর ভাইয়ের কাছে চলে যাই। তখন ঢাকায় চলে আসি।

একদিন পত্রিকায় একটা বিজ্ঞপ্তি দেখলাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতরে দুজন নিম্নমান সহকারী (সার্টিফিকেট লেখক) আবশ্যক। এটা দেখে দেরি করিনি। নিজে নিজে একটা দরখাস্ত লিখি। একদিন সবাইকে ডাকা হয়। প্রাথমিকভাবে সুন্দর হাতের লেখা দেখে ১০০ জনকে বাছাই করা হলো। সেখানে আমার নাম থাকলো। তাদের মধ্যে লিখিত পরীক্ষার পর ১০ জনকে ভাইভার জন্য ডাকা হলো, যাদের মধ্য থেকে দুজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে আমিও ছিলাম। তখন ১৬০ টাকার মূল বেতনে ঢুকলাম নিম্নমান সহকারী হিসেবে। এরপর লেখাপড়াও আর এগিয়ে নিতে পারিনি। ভাগ্যেরও এমন পরিহাস, অনেক ছোটাছুটি করেও লেখাপড়াটা আর হয়নি। এখানেই থেকে গেলাম।

Advertisement

মো. খোরশেদ আলম ভূঁইয়া ১২ বছর নিম্নমান সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর পদোন্নতি পেয়ে উচ্চমান সহকারী হন। এ পদে ছিলেন ১৩ জন। পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।

নিজের সাংসারিক জীবন নিয়ে এই সার্টিফিকেট লেখক বলেন, এরই মধ্যে বিয়ে করলাম। তিনটা কন্যাসন্তান আল্লাহ দিয়েছেন। স্বপ্ন ছিল, তাদের ইউল্যাব স্কুলে পড়াবো। প্রথম মেয়েটার প্রথম বছর ইন্টারভিউ দিয়ে হয়নি। দ্বিতীয় বছর মেঝো মেয়েসহ সে চান্স পায়। এখান থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হয়। এরপর ছোট মেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে পাস করে।

তিনি বলেন, জীবনের শেষের দিকে এসে মনে হলো আমি যখন মরে যাবো, তখন আমার লেখারও মৃত্যু ঘটবে। তাই কিছু একটা করি। কিছু করি ভাবতে ভাবতে ঢাকা শহরে যারা লেখা শেখায় তাদের নিয়ে বসতে চেয়েছি। সবাইকে আমার অফিসে ডেকেছি। এর মধ্যে দু-তিনজন এসেছেন। আর বাকিরা আসেননি। তাদের জানালাম আমার মনের কথা। আমি চাচ্ছি, লেখাগুলোর জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি যদি না হয়, তাহলে সরকারও কোনো পদক্ষেপ নেবে না। যেহেতু আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, বাঙালির সংস্কৃতি সুন্দর লেখা থেকে আমরা অভিভাবকরাও সরে যাচ্ছি। তখন তাদের জিজ্ঞেস করলাম আমরা কী করতে পারি? তারা বললেন, জাতীয়ভাবে যদি সরকার এদিকে নজর না দেয়? তখন আমি বললাম, জাতীয়ভাবে নজর দেয়ার সুযোগটা কোথায়? সরকারের নলেজে তো আনতে হবে। আমি চাই, যেন সরকার এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করি যার যার জায়গা থেকে।

খোরশেদ আলম জানান, লেখার নান্দনিকতা বাড়ানোর জন্য তিনি নতুন নতুন ফন্ট নিয়েও কাজ করেছেন। বাংলা কিংবা ইংরেজি ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে তার বড় মেয়ে রুমানা তাসমিনকে নিয়ে ‘ফাউন্টেন পেন’ নামে হাতের লেখা ও ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণের একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন তিনি।

লেখা সুন্দর করার উপদেশ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যদি আন্তরিকভাবে কেউ চেষ্টা করেন তাহলে তিনি সুন্দরভাবে লিখতে পারবেন। তবে কিছু নিয়ম আছে। যদি কেউ এটা মাথায় রাখে যে আমি যা লিখবো পরিষ্কার করে লিখবো। তবেই তার লেখা সুন্দর হয়ে যাবে। যারা শুরু থেকে সুন্দর লেখার চর্চা করেন তারা পরীক্ষার খাতায়সহ সবসময় সুন্দর লিখতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের একটা ভূমিকা থাকে। তারা যদি ছোট থেকে লেখা সুন্দরের প্রতি জোর দেন, তাহলে বড় হয়েও বাচ্চারা সুন্দর লিখতে পারবে। তাই অভিভাবকের উচিত, সন্তান যে অক্ষরটি লিখছে, তা সঠিকভাবে লিখছে কি না তার দিকে খেয়াল রাখা।

এমএইচ/জেডএ/বিএ