ইন্দোনেশিয়ায় সেদিন যখন ৭.৫ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি থামলো, সেলভি শুশান্তি উঠে দাঁড়ালেন এবং বুঝলেন অদ্ভূত একটা কাণ্ড ঘটছে। আর প্রথমেই তিনি যা দেখলেন তা হলো তার পায়ের নিচের মাটি দেবে যেতে শুরু করেছে।
Advertisement
তিনি যে ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন তাতে চিড় ধরা শুরু করলো। আর তারপর সেটা আবার উঁচুতে ওঠা শুরু করলো। আশপাশের সবকিছুসহ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো ‘কাদার স্রোত।’ এই স্রোত তাকে নারকেল গাছেরও বেশি উঁচুতে নিয়ে অবশেষে থামে।
বাঁচার আশায় চিৎকার করতে করতেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের স্মৃতি মনে করে চোখের পানি মুছতে মুছতে এই নারী বলেন, ‘আমি এসব কী দেখলাম! বাড়িগুলো সব ভেসে যাচ্ছিল। এটাও একটা সুনামির মতোই ছিল। পার্থক্য কেবল এখানে পানির বদলে স্রোত ছিল মাটির। মনে হচ্ছিল আমি একটা নৌকায় আছি। পার্থক্য হলো পানিতে নয়, ভাসছিলাম কাদায়।
ইন্দোনেশিয়ার বিধ্বস্ত এই পেতোবো গ্রামে সুশান্তির মতো আরও অনেকেই জানতেন না যে, তারা এমন এক এলাকায় আছেন যেটাকে সরকার আগে থেকেই উচ্চঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করেছে, কারণ- ভূমিকম্পে সেখানকার মাটি ‘তরল মাটিতে’ পরিণত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ ধরনের ঘটনাকে ‘লিকুইফিকশন’ বলে থাকেন।
Advertisement
কিন্তু ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ইন্দোনেশিয়ায় যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে গেল, যাতে প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন ও নিখোঁজ হয়েছেন কয়েক হাজার, তাতে মোটেও বিস্মিত নন দেশটির বিজ্ঞানী জেজার প্রসত্য। তিনি ওই এলাকার মানুষকে কয়েক বছর ধরে সতর্ক করে আসছিলেন যে, সুলাওয়েসি দ্বীপের ওই অঞ্চলে আগেও বড় ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে এবং সেখানে আবারও এমন ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে, যা থেকে ভূমিধস, সুনামি হতে পারে এবং সেখানকার মাটি মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করতে পারে।
বিষয়টা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে এই বিজ্ঞানী সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশপাশি স্থানীয়দের সঙ্গেও কথা বলেন।
প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে ‘রিং অব ফায়ার’ নামে একটি ভূমিকম্প বলয় রয়েছে। ভৌগলিকভাবে দুর্যোগ-প্রবণ ইন্দোনেশিয়া এ বলয়ের একটা অংশ। ইন্দোনেশিয়ার ১৭ হাজার দ্বীপের অবস্থান এমন এক ‘ফল্ট লাইনে’ যা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু ভূমিকম্প, সুনামি ও অগ্ন্যুতপাতের কারণ হয়ে আছে।
ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ এ ভূমিকম্পের বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানীই এ ভেবে বিস্মিত হয়েছিলেন যে, এই মাত্রার (৭.৫) ভূমিকম্প থেকে কিভাবে ২০ ফুট উচ্চতার সুনামি তৈরি হতে পারে।
Advertisement
জেজার প্রসত্য বলছেন, এমনটা হতে পারে, সেটাও তিনি জানতেন।
প্রায় দুই দশক আগে তিনি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি গেল শতাব্দীতে মাকাস্সার প্রণালীতে ছয়টি সুনামির কথা উল্লেখ করেছেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি নিজের আশঙ্কার কথা জানান যে, প্রতি ২৫ বছর পর পর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ১৯৯৬ সালেও ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। আর ১৯৬৮ সালে পালুর ওই এলাকায় ভূমিকম্পের পর যে সুনামি আঘাত হানে তাতে ৩৩ ফুট উচ্চতার ঢেউ তৈরি হয়।
২৮ সেপ্টেম্বরের ভূমিকম্পের পর কেন এত ভয়াবহ সুনামি তৈরি হলো তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ ভয়াল এই সুনামির জন্য ভূমিকম্পকে দায়ী না করে ওই অঞ্চলের নরম মাটিকে দায়ী করছেন।
আসলেও সেদিন সমুদ্রে কী হয়েছিল তা সম্পর্কে ধারণা পেতে চলতি সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর সঙ্গে কাজ শুরু করবেন প্রসত্য। আন্তর্জাতিক একটি বিশেষজ্ঞ দলও সেখানে কাজ করবে।
সুনামি আঘাত হানার আগে মাটির স্রোত থামার পর ভাগ্যজোরে প্রাণে বেঁচে যান সেলভি শুশান্তি। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমাদের যেন একটা ব্লেন্ডারে ঘোরানো হচ্ছে। আমি দেখছিলাম বাড়িঘর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছে। দেখছিলাম যে বাড়ির মুখ ছিল পূর্ব দিকে তা ঘুরে গেল পশ্চিমে, যে বাড়ির মুখ ছিল পশ্চিমে তা ঘুরে গেল পূর্বে।
বিভিন্ন স্থানে মাটির নিচে থাকা মরদেহগুলো উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে কারণ এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে গেলে ডুবে যাবে। এসব এলাকার অনেকগুলোকে গণকবর হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকারের।
২৮ সেপ্টেম্বর ভূমিকম্পে ‘তরল মাটি’র যে স্রোত বয়েছে সেটানে অনেকে ‘ভূমি সুনামি’ নাম দিয়েছেন। এই সুনামি থেকেই প্রাণে বেঁচেছেন এরলি ইয়াতি নামে ৩২ বছর বয়সী এক নারী। তিনি বলেন, তারা গ্রামটা ভুতুড়ে একটা গ্রাম হয়ে গেছে। আমাকে যদি ১০০ কোটি টাকাও দেয়া হয় আমি তবু ওই গ্রামে ফিরবো না।
সূত্র : এপি।
এনএফ/জেআইএম