বিশেষ প্রতিবেদন

ঐক্য প্রক্রিয়া : কী ভাবছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ

গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এবং বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর (বি. চৌধুরী) নেতৃত্বে রাজনীতিতে যে নতুন জোট গঠন প্রক্রিয়া চলছে এ নিয়ে রাজনীতিতে যেমন আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তেমনি এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রাজনীতির বাইরের মানুষদের মধ্যেও।

Advertisement

গেল আগস্টে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা তৈরির লক্ষ্যে অন্য দলগুলো নিয়ে যে জোট গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় সেপ্টেম্বরে এসে তা কার্যত সরকারবিরোধী জোটে পরিণত হয়।

‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ নামে এই নতুন রাজনৈতিক জোটে আরও রয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি একাংশের সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। বিএনপিও এই নতুন জোটের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে।

গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’র উদ্যোগে নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে কয়েকটি বাম ও ইসলামী দলের পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ দলটির চারজন সিনিয়র নেতা যোগ দেন।

Advertisement

রাজনীতিতে নতুন এই জোট প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রথমে স্বাগত জানানো হলেও পরবর্তীতে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। অন্যদিকে আওয়ামী-বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে নতুন জোটকে স্বাগত জানিয়ে রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব নিয়ে পিছিয়ে নেই রাজনীতির বাইরের মানুষও। আবার কারও কারও আগ্রহ নেই রাজনীতির এসব হিসাব-নিকাশ নিয়ে।

ড. কামাল হোসেন এবং বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন সম্পর্কে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রকৌশলী আকিব খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় ড. কামাল হোসেন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেশ নিয়ে ভাবেন। তারা গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটানোর জন্য আসতে পারেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে যেসব দল রয়েছে তারা কি গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে চান নাকি শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছেন- এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।’

তিনি বলেন, ‘ড. কামাল হোসেন এবং বি. চৌধুরীর পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। তারা সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য চাচ্ছেন। জামায়াতকে বাদ দিয়ে সরকার গঠনের চিন্তা করছেন। তবে এত ভিন্ন আদর্শের দল নিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত এ অবস্থানে থাকতে পারবেন কি-না সেটা দেখার বিষয়।’

একটি মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাকলায়েন রাসেলের মতে, ‘এই জোটের বিরুদ্ধে সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে মনোভাব প্রকাশ করেছেন তাতে মনে হয়, কিছুটা হলেও মাথাব্যথার কারণ হয়েছে।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘বিকল্পধারা ছাড়া নতুন জোটের দলগুলোর ভোটার সংখ্যা হাতেগোনা। সেক্ষেত্রে ভোটের রাজনীতিতে এই জোটের প্রভাব কতটুকু সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে এই জোট কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারে সেটাও দেখার বিষয়।’

একটি জাতীয় দৈনিকের বিজ্ঞাপন বিভাগের উপ-ব্যবস্থাপক বীথি চৌধুরী বলেন, ‘আমি মনে করি না তাদের এ জোট প্রক্রিয়া রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে। কারণ এই ধরনের জোট এখানকার রাজনীতিতে একেবারে নতুন কোনো ফর্মুলা নয়।’

তিনি বলেন, ‘এই জোটকে সাধুবাদ জানানোর মতো পরিস্থিতি এখনও সৃষ্টি হয়নি। কারণ তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ করা। আর রাজনীতির মাঠে এই উদ্দেশ্য কোনো অপরাধ নয়। তবে আমার মনে হয় তারা নিজেদের মধ্যেই জোটের লক্ষ্য ও করণীয় বিষয়ে খুব পরিষ্কার নন। এ কারণেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে মিডিয়ার সামনে তারা একেকজন একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন।’

বীথি চৌধুরী বলেন, ‘আমি মনে করি না ড. কামাল হোসেন এবং বি. চৌধুরীর জোট কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটাবে। যদি তাইই হতো তাহলে এত ঘটা করে জোট গঠনের প্রয়োজন নেই তো। অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় গেলে সেখানে সমর্থন দিয়ে তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেন। জোট করে আগেভাগে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এরপর আসল উদ্দেশ্যে যাওয়া তো- ঘোলা করে গাধার জলপানের মতো বিষয় হয়। তাদের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এতটা বোকা নন।’

উন্নয়নকর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন বলেন, ‘এক বাক্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রত্যাশী সকলকে স্বাগতম জানাই। নির্বাচন করা বা রাজনীতি করা প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার। সন্দেহের চোখে দেখে কিংবা ভবিষ্যতে কী হবে তার আনুমানিক ধারণা থেকে কাউকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।’

তিনি বলেন, ‘দেশে নির্বাচন আসলে দলগুলোতে ঐক্য হয়। কিন্তু জনগণের স্বার্থে কিংবা জনগণের দুর্ভোগ মোকাবেলায় কখনও এরা ঐক্যবদ্ধ হয় না। তাই এটা পরিষ্কার যে এই ঐক্য শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার। তাতে জনগণের স্বার্থ কতটা রক্ষা হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ কথা সত্য এখন যে পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তাতে যে আসবে তার কাছ থেকে খুব বেশি পরিবর্তন আশা করা যায় না। আগে মূল কাঠামোতে সংস্কার করতে হবে। কামাল হোসেনরা সেই দিকে যাবেন না।’

শোভন বলেন, ‘ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশায় যে কেউ জোট করতে পারে। যারা রাজনীতিতে আসতে চায় তাদের আসতে দিতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। সে হিসেবে ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তাদের অবস্থান থেকে চেষ্টা করতেই পারেন। তারা কতটা পরিবর্তন আনতে পারবেন সেটা সময়ই বলে দেবে।’

বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এস এম অারিফুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচনের আগে এই জোট বিএনপির আন্দোলনের জন্য একটা সুবিধা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। জোট প্রক্রিয়ায় যারা রয়েছেন ভোটের বাজারে তাদের অবস্থান না থাকলেও দেশ-বিদেশে তাদের একটা পরিচিতি রয়েছে। বৃহত্তর ঐক্য গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন হলে সরকার চাপে থাকবে।’

একটি বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. কায়দে আজম সরদার বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া এতদিন আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, এখন সেই নেতৃত্বটা ড.কামাল হোসেন এবং বি. চৌধুরীরা দিতে চাইছেন বলে আমি মনে করি। খালেদা জিয়ার মুক্তি বা তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নাই। তারা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে মাইনাস করে বিএনপির ওপর ভর করে আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্বে আসার জন্য এই জোট প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন।’

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা টিভি’র সংবাদ পাঠক কাজী সাঈদুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন জোটকে স্বাগত জানাই। তাদের মাধ্যমে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’

চ্যানেল একাত্তরের বিশেষ প্রতিনিধি শফিক আহমেদ মনে করেন, সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নতুন জোট রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করবে।

এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নিয়াজ জামান সজীব বলেন, ‘এ জোট হলো ক্ষমতায় যাবার জন্য। শুধু নির্বাচন সামনে রেখে এই জোট রাজনীতি পুরনো। বিরোধিতার জন্য এই রাজনীতি থেকে জনগণ আগে কতটা লাভবান হয়েছে তা সবাই জানে। তাই তাদের স্বাগত জানাতে শঙ্কা হয়।’

এস এ টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফারজানা শোভা বলেন, ‘নতুন দল বা জোট রাজনীতিতে নতুন হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার অবস্থা নির্দেশ করে। তবে অতীত বলে, জোট আদর্শিক না হয়ে কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক হলে তা কখনওই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেটার রাজনীতি ক্ষমতা ভাগাভাগির জয়, জনমুখী নয়। ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীদের নির্বাচনের আগমুহূর্তে এই জোট, কতদিন ধরে রাখতে পারবে সে বিষয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কে কোন পদ পাবে এই স্বল্প সময়েই তা নিয়ে একদিকে যেমন নতুন জোটের মধ্যে বিরোধের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে ভাঙনও দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ইতোমধ্যেই জোটের কর্মসূচি অঘোষিতভাবে বয়কট করেছে। এই প্লাটফর্মে মিলেছে ডান-বাম, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মভিত্তিক নানা দল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি জামায়াত ও তাদের দোসরদের সঙ্গে রাখা না রাখা নিয়েও জোটে মতভেদ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘শুরুতেই এত মতবিরোধ নিয়ে তারা কী করে জাতীয় ঐক্য গড়বেন? তবু কোনো ধরনের ঐক্য যদি হয়, বিএনপিরই কিছুটা লাভ হবে। এই জোটের ভোটের বাক্স শূন্য প্রায়। অন্য দলের কাঁধে ভর করেই তাদের সংসদে যেতে হবে। অতীতেও দেখা গেছে, কাগজসর্বস্ব কিছু দল নির্বাচন আসলেই জোট করে নিজেদের জানান দেন। এতে ব্যক্তিবিশেষের লাভ হয় বটে কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক বা নেতিবাচক উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না।’

একটি বেসরকারি হাসপাতালের পথ্য ও পুষ্টি বিভাগের পরামর্শক তামান্ন রুবিন বলেন, ‘রাজনীতি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই এবং সত্যিকার অর্থে সময়ও নেই। যেদিকে যাচ্ছে যাক। কোনো কিছুতেই আমার কোনো উপকার বা ভাগ্য পরিবর্তন করবে না। এক্সট্রা পেইন নেয়ার দরকার নাই। এমনিতেই অনেক প্যারা।’

কেএইচ/বিএ/পিআর