ক্যাম্পাস

সাক্ষাৎ হলে প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে আমেরিকা যেতে হতো না

আচার্য হিসেবে সমাবর্তনে বক্তব্য দিতে গিয়ে রসিকতা করবেন না- এমনটি যেন মানায় না রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে ‘হেলিকপ্টার’ ও ‘হাতের ব্যায়াম’ নিয়ে তার বক্তব্যে মজেন গ্র্যাজুয়েটরা। এরও আগে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি মজা করে বলেন, ‘বুড়া বাতিল না হলে পথ পরিষ্কার হচ্ছে না’।

Advertisement

এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১তম সমাবর্তনে যোগ দিয়ে ভারতীয় নায়িকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে রসিকতা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আবদুল হামিদ।

শনিবার অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বঙ্গভবনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী (রাষ্ট্রপতির স্ত্রী) নাকি ফোন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বঙ্গভবনে আসার কী দরকার!’

‘এই ধরনের একটা সুযোগ নষ্ট, এটা সে ঠিক করেনি। আসার পর যদি ঘটনা ঘটতো অন্তত এই উপ-মহাদেশের একটা মেয়েকে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে সুদূর আমেরিকা যেতে নাও তো হতে পারত। সবই কপাল-ভাগ্য, কিছু করার নেই’- বলেন রাষ্ট্রপতি।

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত বক্তব্যের বাইরে স্বভাব-সুলভ মজার কথাবার্তায় সমাবর্তন প্রাঙ্গণ মাতিয়ে রাখেন রাষ্ট্রপতি।

আবদুল হামিদ বলেন, ‘কবে আমি বিয়া করছি...আজকে হিসাব অন্যভাবে বলবো- ১৭০ কোটি ২ লাখ ৯২ হাজার ৪০০ সেকেন্ড হয়ে গেছে। হঠাৎ বলতে পারবেন না সময় কতদিন হয়েছে। আসলে হয়েছে ৫৪ বছর দু’দিন। এটা হওয়ার কারণ হলো কী- এ বাচুপানকে মোহাব্বতের মতো কম বয়সে বিয়া কইরা ফালাইছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘৫৪ বছরে একটা মহিলা তো মোটামুটি আমার সবকিছুই বুইঝা ফেলছে। ভালো-খারাপ, কী করতে পারি না পারি। এটা কিন্তু তার কন্ট্রোলের ভেতরে। আমি যখন ৭/৮ বছর আগে স্পিকার ছিলাম, যখন আমি নারী নির্যাতন বিল পাস করি তখন আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনি নারী নির্যাতন বিল পাস করছেন, ভালো কথা; কোন অসুবিধা নেই। পুরুষ নির্যাতন বিল পাস করাও তো প্রয়োজন।’

‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেন, এটা এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। পরে দেখা যাবে, যদি হয়; তবে করা হবে। ছয় বছর চলে গেছে এখনও কিন্তু করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী খবর-টবর রাখেন না, আসলে খালি আমার ঘরেই নয়, সারা বাংলাদেশেই পুরুষ নির্যাতন যে কিছু হচ্ছে না, এই কথাটা ঠিক নয়। এটা কিন্তু মারাত্মকভাবে হচ্ছে। ভুক্তভোগীরাই এটা টের পাচ্ছে।’

Advertisement

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া...প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে তো সবাই চেনেন। আমি যদিও বুড়া বয়সে চিনি, এই ছেলেদের তো না চেনার কোনো কারণ নেই। এই প্রিয়াঙ্কা চোপড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঢাকা আসছিলেন। বাংলাদেশে অন্য দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আসলে তারা বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা করে সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে বঙ্গভবনে আসেন। সবাই আসেন।’

তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে বললাম এবার তো প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আসবে। আসার একদিন আগে এই কথা বললাম- পরে শুনেছি সে (রাষ্ট্রপতির স্ত্রী) নাকি টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বঙ্গভবনে আসার কী দরকার!’

হর্ষধ্বনি উঠতে থাকে সমাবর্তন মাঠে। এর মধ্যেই রাষ্ট্রপতি বলে চলেন, ‘ইট ওয়াজ জাস্ট কন্সপাইরেসি, ষড়যন্ত্র। শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বঙ্গভবনে আসা ক্যানসিল, তিনি আসেননি।’

‘প্রিয়াঙ্কা চোপড়া যাওয়ার কয়েক মাস পরে শুনলাম সে আমেরিকা গেছে, তার চেয়ে ১০ বছরের, ১০ বছরের না আরও বেশি ১২/১৪ বছরের নিক নামের ছেলেরে বিয়া করছে, আমেরিকা গিয়ে। আমি তো তার চেয়ে ৩০/৩৫ বছরের বড়। সে যদি ১২/১৩ বছর নিচে নামতে পারে তাহলে সে ৩০/৩৫ বছর উপরেও তো উঠতে পারত’ বলেই রাষ্ট্রপতিও হাসতে থাকেন। আর হাসির রোল পড়ে যায় উপস্থিত গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে।

এরপর তিনি বলেন, ‘এই ধরনের একটি সুযোগ নষ্ট, এটা সে ঠিক করেনি। আসার পর যদি ঘটনা ঘটত অন্তত এই উপ-মহাদেশের একটা মেয়েকে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে সুদূর আমেরিকা যেতে নাও তো হতে পারত। সবই কপাল-ভাগ্য, কিছু করার নেই।’

আবদুল হামিদ বলেন, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আসলে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও মনটা চাঙ্গা হয়ে যায়।’

এরপর লিখিত বক্তব্যের শেষ প্যারাটা পড়তে শুরু করেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘প্রিয় গ্র্যাজুয়েটগণ তোমরাই জাতির ভবিষ্যৎ তোমরাই দেশ পরিচালনা করবে। তোমাদের সঠিক নেতৃত্বে দেশ হবে উন্নত, সমৃদ্ধ। জীবন চলার পথে তোমাদের আদর্শ থাকতে হবে। সেই আদর্শ ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। তাই কখন সত্যের সঙ্গে মিথ্যার, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের আপস করবে না। সব সময় তোমরা বিবেককে জাগ্রত রাখবে। জীবনে চড়াই-উৎরাই আসবে, সব সময় অর্জিত জ্ঞান, মেধা, মনন ও বিবেক দিয়ে সামনে আগ্রসর হবে। জীবন-জীবিকার জন্য তোমার পৃথিবীর যেখানে যাও না কেন প্রিয় মাতৃভূমিকে ভুলবে না, ভুলবে না এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের কথা।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বমানের মানবসম্পদ তৈরি, নতুন চিন্তা-গবেষণা ও উদ্ভাবনী আত্মনিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনেকাংশে সফল। যুগের চাহিদা ও উপযোগিতা বিবেচনা করে নতুন নতুন বিভাগ খুলতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’

সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে ভাবতে বললেন রাষ্ট্রপতি

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি স্বাভাবিক লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে কি-না তা ভাবতে হবে। আমি মনে করি জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্র, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা ভেবে দেখবেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এবার সর্বাধিক সংখ্যক ২১ হাজার ১১১ জন গ্র্যাজুয়েট রেজিস্ট্র্রেশন করেন। কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৬টি স্বর্ণ পদক, ৮১ জনকে পিএইচডি ও ২৭ জনকে এমফিল ডিগ্রি দেয়া হয়।

অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আরও বক্তব্য দেন উপাচার্য মো. অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রপতি রসিকতা করে বলেন, ‘দেখেন আমি খুব দ্রুত লিখিত বক্তব্যটি পাঠ করছি। দেরি হয়ে গেলে হেলিকপ্টার নিয়ে আর ফিরতে পারব না। পাঁচদিন ঘুইরা আইচি হাওড় এলাকায়, দুর্গম এলাকায়, অনুন্নত এলাকায়। রাজশাহী তো অনেক উন্নত এলাকা, তবে এখানে গরম আবার খুব বেশি। আজকে যেভাবে আপনারা হাতের ব্যায়াম করছেন, এই ব্যায়াম দেখে বেশি কথা বলার মতো সাহস আমার নাই। পত্রিকা আর খাতা দিয়া যে ব্যায়াম হচ্ছে (খাতা দিয়ে বাতাস করা), এটা ছাড়া আমি কিছু আর দেখছি না।’

‘বুড়া বাতিল না হলে পথ পরিষ্কার হচ্ছে না’

গত ৭ ফেব্রুয়ারি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে রসিকতা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দ্বিতীয় মেয়াদে আজ রাষ্ট্রপতি হয়েছি। এতে আমি খুশি হলেও তোমরা খুশি হতে পারোনি। কারণ বুড়া বাতিল না হলে তোমাদের পথ পরিষ্কার হচ্ছে না। বড় ভাইয়ের বিয়ে না হলে যেমন ছোট ভাই বিয়ে করতে পারে না—তেমনই ব্যাপার। তবে হতাশ হইয়ো না। বুড়া হয়ে গেছি আগামী পাঁচ বছর বাঁচবো কি-না ঠিক নাই।’

রাষ্ট্রপতি রসিকতা করে আরও বলেন, ‘যশোর অঞ্চলে এসে লিখিত বক্তব্যের বাইরে কথা বলতে ভয় পাই। কী বলতে কী বলে ফেলাই। কারণ এখানকার মানুষ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে।’

এছাড়া ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম সমাবর্তনে বক্তব্য দিতে গিয়ে রসিকতা করে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আবদুল হামিদ বলেন, ‘আপনারা জানেন যে আচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এটিই আমার প্রথম যোগদান। আরেফিন সিদ্দিক যেভাবে বললেন, জিল্লুর রহমান সমাবর্তনে যোগ দেওয়ার কয়েক দিন পরই ইন্তেকাল করেছেন। এরপর থেকে আমার মনের অবস্থা যে কী, সেটা আপনারা ভালোই বুঝতে পারছেন।’

রাষ্ট্রপতির এ কথা শুনে সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে।

এরপর রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘এখান থেকে যাওয়ার পর কী হবে জানি না; তবে এখানে এসে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।’ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা দেশ ও সমাজের কাছে ঋণী। এ দেশ ও সমাজ তোমাদেরকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।’

আরএমএম/এমআরএম/আরআইপি