অর্থনীতি

হাজার কৃষকের সফল গল্পের কারিগর প্রাণ এ্যাগ্রো

১৯৯৯ সালের কথা। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমের মৌসুম তখন। বাজারে গিয়ে দেখি মানুষ আম বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ গরু-ছাগলের জন্য পানির দামে কিনে নিচ্ছেন। দেখে অবাক হলাম। যে আম গাছটি বাড়ির আঙ্গিনায় সযত্মে রাখা সেই গাছের ফল নিয়ে কত অবহেলা! ব্যবসা নিয়ে নতুন ভাবনা চলে এলো মাথায়। গ্রাম ঘুরে ঘুরে আমের বাজার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে ধারণা নিতে থাকলাম। এখন আমি বেশির ভাগ আমই কিনি উত্তরের জেলাগুলো থেকে।

Advertisement

নিজের দিনবদলের কথা বলছিলেন নাটোরের একডালা গ্রামের বাসিন্দা মো. আফসার আলী প্রামাণিক। প্রতিষ্ঠার সময় প্রাণ কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি করেছিলেন আফসার আলীও। সেই প্রাণ-এর মাধ্যমেই ভাগ্য বদলিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন >> বর্তমানে বিশ্বের ১৪০ দেশে যাচ্ছে প্রাণ-এর পণ্য : আহসান খান চৌধুরী

আফসার আলী ১৯৯২ সাল থেকে প্রাণ কোম্পানিকে আমসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করে আসছেন। নরসিংদীর ঘোড়াশালে প্রাণের মাধ্যমেই তার আমের ব্যবসা শুরু। নাটোরের একডালায় প্রাণ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর তার ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। ২০০১ সাল থেকে নাটোরের প্রাণ এ্যাগ্রো লিমিটেডে আম সরবরাহ করছেন। ব্যবসার গতি আনতে মাস্টার্স পাস ছেলেকেও সঙ্গে নেন। বিশ্বাস ও আস্থার মধ্য দিয়ে তিনি আজ স্থানীয় চাষিদের কাছেও বিশেষ পরিচিত।

Advertisement

সম্প্রতি নাটোরে গিয়ে সাক্ষাৎ মেলে এই সরবরাহকারীর। জাগো নিউজের কাছে বলছিলেন জীবনের গল্প। ভাগ্যবদলের গল্প শোনালেন অন্যদেরও। বলেন, একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরুর সময় জমি ক্রয়ে জটিলতায় পড়তে হয়। ১৯৯৬ সালের দিকে প্রাণ কোম্পানি যখন প্রথম ১৬ বিঘা জমি ক্রয় করে, সে জমিতে আমাদের অংশীও ছিল।

তিনি বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছায় জমি বিক্রি করেছি প্রাণ গ্রুপের কাছে। কারণ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে আমাদের ভাগ্য বদল সম্ভব, এলাকার উন্নয়ন সম্ভব। এলাকার মানুষের সহায়তা নিয়েই এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। যার ফল আজ আমরা পাচ্ছি। একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যের কী পরিবর্তন আসতে পারে তার হাজারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে প্রাণ এ্যাগ্রো লিমিটেড।’

আরও পড়ুন >> নেদারল্যান্ডসে ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করবে প্রাণ

তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার চাষিরা প্রত্যেকেই এখন প্রশিক্ষক। চাষাবাদ, ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণসহ সবকিছুতে দক্ষ তারা। হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে প্রাণ কোম্পানিতে। কৃষকদের ফসল বিক্রি নিয়ে এখন আর চিন্তা করতে হচ্ছে না। ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন তারা।’

Advertisement

আফসার আলীর মতো হাজার হাজার মানুষের সফল গল্পের কারিগর প্রাণ এ্যাগ্রো লিমিটেড ও নাটোর এ্যাগ্রো লিমিটেড। মাত্র দুই দশকের যাত্রা সেখানে। তাতেই যেন একটি এলাকার মানুষের প্রাণের প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে এটি। প্রাণ-এর অর্জনই এলাকার অর্জন বলে মনে করে নাটোরের মানুষ।

কথা হয় নাটোরের আরেক আম ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমের সঙ্গে। ডিগ্রি পাস করলেও ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। চাকরির জন্য ব্যাকুল না হয়ে কৃষিকাজের পাশাপাশি মন দেন ব্যবসায়। ২০০১ সাল থেকে প্রাণ এ্যাগ্রো লিমিটেডে বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহ করছেন তিনি। কৃষকদের অধিকার নিয়ে নেতৃত্বেও থাকছেন তিনি। ছেলে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে এখন সেনাবাহিনীর অফিসার। একমাত্র মেয়েকেও ক্যাডেট কোচিং করাচ্ছেন। যে জীবন বেকারত্বের অভিশাপে ঘেরা ছিল, সেই জীবন এখন সফলতার গল্প বুনছে রোজ।

জাগো নিউজ-এর কাছে এই ব্যবসায়ী জীবনের গল্প তুলে ধরেন প্রাণ কোম্পানিকে সারথী মেনে। বলেন, চার একর জমিতে এখন আমার পাঁচশ আম গাছ। ভাগ্যের যে পরিবর্তন, তা অনেকটাই প্রাণ কোম্পানির মাধ্যমে। আমার মতো শত শত সরবরাহকারী, খামারি, প্রান্তিক কৃষক আজ প্রতিষ্ঠিত। ভালো মূল্য পেতে কৃষকরা জানছেন কী করে ভালো ফসল ফলাতে হয়। তারা এখন জমির উর্বরতা বাড়াচ্ছেন প্রাকৃতিক উপায়ে।

আরও পড়ুন >> ভারতজুড়ে প্রাণের পণ্য পৌঁছে দেয়া আমাদের লক্ষ্য : আহসান খান চৌধুরী

তিনি বলেন, প্রাণ কোম্পানি না এলে নাটোরকে চেনা যেত মঙ্গা এলাকা হিসেবে। বাড়ির আঙ্গিনার একটি গুটি আমের গাছ থেকে মানুষ এখন হাজার হাজার টাকা আয় করতে পারছেন। অথচ একসময় এই আম নষ্ট হতো, ফেলে দিয়া হতো। আপনি এলাকা ঘুরে আর খড় বা টিনের ঘর পাবেন না। কম-বেশি সবাই এখন ইটের ঘরে থাকছেন। প্রায় বাড়িতে আছে মোটরসাইকেল। এর পেছনে প্রাণের অবদান কম নয়। নাটোর এখন বাংলাদেশের মধ্যে উন্নয়নের মডেল এবং সেটা পরীক্ষিত। এ উন্নয়নে প্রাণ এ্যাগ্রো লিমিটেডের ভূমিকা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।

নাটোরের জংলী ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য রোকেয়া বেগম। বলেন, প্রাণ এখন আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান। ১৪ বছর আগে স্বামী মারা যায়। স্বামীহারার পর গার্মেন্টে কাজ করতে গিয়েছিলাম। ভালো লাগেনি। বাড়িতে ফিরে আসি। যেটুকু জমি তাতে আম চাষ শুরু করি। প্রাণ কোম্পানিতে আম দিতে পেরে সংসারে নির্ভরতা আসে। এ বছর সবমিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকার আম বিক্রি করেছি। যার অধিকাংশই প্রাণ এ্যাগ্রো কিনেছে। আমার মতো শত শত অসহায় নারী এখন স্বনির্ভর প্রাণ কোম্পানিতে ফসল বিক্রি করতে পেরে।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি