মতামত

ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা

 

নির্বাচন আসছে। নানা খেলা জমে উঠছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে উদার অসাম্প্রদায়িক সংবিধানের রচয়িতা ড. কামাল হোসেনদের মঞ্চে দেখা গেল ডান বামের সাথে কয়েকজন হেফাজত নেতার মিলন মেলা।

Advertisement

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকানরী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা গেয়ে চলেছেন হেফাজতের বড় নেতা মওলানা আহমদ শফি। ইতোমধ্যে কওমি মাদ্রাসার বড় ডিগ্রি নেয়া ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েই মাস্টার্স ডিগ্রির মর্যাদা ভোগ করতে শুরু করেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক ইসলামী দলতো আছেই।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে দেশে পরিকল্পিতভাবে উদার মানবতাবাদী মানুষদের নাস্তিক বলা, মুক্তমনা ব্লগারদের ধরে গলা কাটা, জঙ্গিবাদকে আবার সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এগুলো সবই দুর্ভাগ্য গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের।

রাজনীতিকদের তাগিদটা বোঝা কঠিন নয়। মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতাকে তাদের সমীহ করতেই হচ্ছে। ধর্ম ব্যবসায়ী দল ও ব্যাক্তির কৌশলগত ভোটদানের উপর ভরসা করে ঘুঁটি সাজাতে গিয়ে এদের ভোট টানার প্রতিযোগিতায় সবাই কোমর বেঁধে নেমেছে। ভোটের যুদ্ধে এই রণ কৌশলে কি ভুল আছে সেটা নিয়ে ভাবেননা রাজনীতিকরা।

Advertisement

দেশের মানুষ বরাবরই ধর্মপ্রাণ। কিন্তু এই মানুষ কখনো দল বেঁধে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে উজার করে ভোট দিয়েছেন, সেই প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। তাই এসব দল ভোটের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে এই সমীকরণটি কতটা ঠিক সে নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোন প্রাক বা উত্তর-নির্বাচনী সমীক্ষায় হয়নি, ভোট-পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ থেকেও তা তা উন্মোচিত হয়নি। বাংলাদেশের আপামর মানুষ এদের নিয়ে মাথা ঘামায়, এমন কোন প্রমাণও নেই।

বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল। তার ভিত্তিটা সে কারণেই সমাজের গভীরে প্রোথিত। যে বাংলাদেশের মানুষ সর্বস্ব ত্যাগ করেছে একটি উদার অসাম্প্রদায়িক দেশ পেতে তারা রাতারাতি সাম্প্রদায়িক হয়েছে, একথা বিশ্বাস করা যায় না। তবে একথা সত্যি, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যে রাজনীতি সামরিক শাসকরা বাংলাদেশে চালু করেছিল, তা ছিল ভয়ংকরভাবে ধর্ম ব্যবসা ভিত্তিক।

রাজনীতিকরা ধর্মব্যবসায়ীদের তোষণ করেন, করতে হয় নানা স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে। শাসক ও বিরোধী, মানুষকে, তাদের চাওয়া পাওয়াকে বিবেচনায় না নিয়ে এদের কাছে টানার পরিকল্পনা রচনায় ব্যতিব্যস্ত। সত্যি বলতে কি কার্যত এরা গলেনা, গলার ভাণ করে। তারা তাদের মত করে সমাজকে যেভাবে দেখতে চায় তার যাবতীয় আয়োজন করতে থাকে। তারা উদার, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিকে যত বিপদে ফেলা সম্ভব সবই করে যেতে থাকে। রাজনীতিকরা ভাবেন, এমনটি করে তারা সফল হয়ে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে ধর্মীয় নেতাদেরও সমস্যা আছে, চ্যালেঞ্জ আছে। তারা যেহেতু এই রাজনীতিটি করেন, অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তাদের নিজ নিজ গোষ্ঠিকে নিরন্তর বিপন্নতার মধ্যে, প্ররোচনা ও উস্কানির মধ্যে ফেলে রাখতে হয়। ধর্ম গেল গেল বলে রণধ্বনি তুলে হিংসায় নামতে তারা মানুষকে প্ররোচিত করেন, যেন রাস্তায় নেমে ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ, করলেই, সংখ্যালঘুদের চোখ রাঙ্গাইলেই নিজেদের সব বিপণ্ণতা দূর হয়ে যাবে। এ ভাবেই ইসলাম বিপণ্ণ বলে প্রচার করে পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন লেখক, লেখিকাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়, বিদেশ থেকে নিজ দেশের বই মেলায় এসে মুক্তমনের লেখককে খুন হতে হয়।

Advertisement

শিক্ষার প্রসারে, চিকিৎসা সেবা দেয়া অভিযানে, নারীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ায়, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ দূর করার আয়োজনে যদি এই ধর্মীয় নেতারা বেশি সময় দিতেন তাহলে তারা নিজেরাই অনেক বেশি করে মানুষের মন জয় করতে পারতেন, তাদেরকে অন্য রাজনীতিকদের দ্বারস্থ হতে হতোনা। কারণ তারা হয়তো মনে করেন এগুলো যদি অর্জিত হয়, তাহলে তারা নিজেরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন। তাই তার ভয় দেখান, লোক খ্যাপান রণহুঙ্কার দেন, উগ্রতাকে তাতিয়ে দিতে চান।

সেক্যুলার বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, উভয়ই এখন মানুষকে পথনির্দেশ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি অনেক বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক বলেই, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করবে এটাই সহজ কথা। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এমনটাই ভেবেছিলেন এবং জনগণ ১৯৭০-এ সেই ভাবনার প্রতিই রায় দিয়েছিল।

সভ্যতার সড়ক পেরিয়ে আজ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান, তার প্রতি সাধারণ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির নতজানু মনোভাব, সবই ধর্মনিরপেক্ষতা মডেলের ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে প্রগতি, স্বাধীনতা এবং বৈজ্ঞানিক মানসিক বিকাশের অঙ্গ, এগুলি হলেই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়। যারা সেক্যুলার রাজনীতি করছেন বলে দাবি করেন, তারা আসলে নিজেরা এসব থেকে অনেক দূরে। অন্যদিকে দখল আর দুর্নীতির যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটিয়েছে এসব রাজনীতিক, সেদিক থেকেও এক ধরনের ভয়ে এত আপোস করতে হচ্ছে তাদের।

পশ্চিমে চার্চ ও রাষ্ট্র, ধর্ম ও রাজনীতি যে ভাবে পৃথক হতে পেরেছে সে ভাবে আমাদের সমাজে রাজনীতি ও ধর্ম পৃথক হতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে, এবং ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর থেকে যে রাজনীতি এসেছে, সেখানে রাজনীতিকরা বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছেন, ব্যস্ত থেকেছেন কেবল সম্পদের পাহাড় গড়তে। আমরা পুঁজিবাদী বিকাশের দিকে এগিয়েছি আর বৈষম্যকে বিকশিত করেছি। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে।

শুধু জামায়াত হেফাজতের বিরোধিতা করলেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ হয় না। দখল উৎসব আর দুর্নীতি থেকে দূরে গিয়ে, গোটা দেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে পারলেই মানুষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পানে আবার ছুটবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস