প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন আমি খুব আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে দেখি। শুধু আমি নই, আমার ধারণা, শেখ হাসিনার শত্রু-মিত্র সবাই-ই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেন। এ সময় টেলিভিশনের দর্শকও থাকে সর্বোচ্চ। সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি তাৎক্ষণিক সপ্রতিভতায়। কখনো কখনো পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
Advertisement
সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্স মানেই জমজমাট আয়োজন। তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে ভালোবাসেন। প্রতিবার বিদেশ সফর শেষে ফিরে দ্রুততম সময়ে তিনি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। তবে ইদানীং শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল। সে দায় অবশ্য তাঁর নয়, আমাদের। সাংবাদিকদের স্তুতিমূলক প্রশ্ন নিয়েই যত সমালোচনা।
সে তুলনায় বুধবারের সংবাদ সম্মেলন ছিল অনেক প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য। শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম অনুরোধ করেন ভূমিকা ছোট করে মূল প্রশ্ন করার। বুধবার অধিকাংশ সাংবাদিকই তার অনুরোধ রেখেছেন এবং বেশির ভাগ প্রশ্নই ছিল প্রাসঙ্গিক ও টু দ্যা পয়েন্ট। তাই সংবাদ সম্মেলন, সত্যিকারের সংবাদ সম্মেলনেরর মত হতে পেরেছে।
তবে সংবাদ সম্মেলনে অপ্রয়োজনে দলীয় নেতাদের উপস্থিতি ছিল দৃষ্টিকটু। এর আগের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এক প্রশ্নের জবাবে করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে গণভবনের হলরুম। সাংবাদিকরা করতালি দিয়েছেন, এই অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সমালোচনায় মুখর ছিল। কিন্তু সাংবাদিকরা নন, করতালি দিয়েছিলেন উপস্থিত দলীয় নেতারা।
Advertisement
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রধানমন্ত্রী নিজে তাদের নিবৃত করেন। ভবিষ্যতে সংবাদ সম্মেলনে অপ্রয়োজনে দলীয় নেতাদের উপস্থিতি বন্ধ করতে পারলে সংবাদ সম্মেলন আরো প্রাসঙ্গিক হবে।
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে যথারীতি নানা প্রসঙ্গ এসেছে। খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির ময়দান, এসকে সিনহা থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নির্বাচনী জোট থেকে নির্বাচনকালীন সরকার, কোটা বাতিল থেকে ইভিএম- সব প্রসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর বিচরণ ছিল সাবলীল, আত্মবিশ্বাস ছিল উচ্চারণে।
যথারীতি সাংবাদিকদের মূল প্রশ্ন, শঙ্কা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলে দিলেন, ‘অপরাধী মন না থাকলে উদ্বেগের কিছু নেই।’ তিনি বরং যারা মিথ্যা সংবাদ ছাপে, তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ধারা অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন।
বললেন, মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে কাউকে হেয় করলে, তা প্রমাণের দায়িত্ব সেই পত্রিকাকেই নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বললেন, 'আমি যতদিন আছি, ভয় নেই।' তবু আমাদের ভয়-উদ্বেগ যায় না। কারণ এ আইনে পুলিশকে এমন সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে চাইলে তারা সরকারকে বিব্রত করার জন্য হলেও সাংবাদিকদের ধরে চালান করে দিতে পারবে।
Advertisement
চুন খেয়ে মুখ পোড়া আমাদের। ৫৭ ধারার যে ঢালাও অপপ্রয়োগ দেখেছি; তাতে ডিজিটাল আইন উদ্বেগ-শঙ্কা যায় না। আর আইন তো শুধু শেখ হাসিনা সরকারের আমলের জন্য করা হয়নি। ভবিষ্যতের কোনো সরকার যে অপপ্রয়োগ করবেন না, তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই অপপ্রয়োগের সুযোগ যেন না থাকে, পুলিশ যেন দৈত্য হয়ে উঠতে না পারে, স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়; তা নিশ্চিত করতে হবে আইনেই।
কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর অভিমানটা আমি বুঝতে পারি। তিনি বরাবরই কোটার পক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনে বিরক্ত হয়ে তিনি সংসদে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোটা বাতিল করে দেবেন। সচিব কমিটির সুপারিশ আকারে সে ঘোষণা মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে। ২/৩ দিনের মধ্যে হয়তো প্রজ্ঞাপন হয়ে যাবে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশে তো এখনও সব মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত নয়। এখনও সমাজে প্রবল বৈষম্য বিদ্যমান। কোটা না থাকলে সে বৈষম্য প্রবলতর হবে।
আর কিছু অবুঝ শিক্ষার্থী পেছনে অন্য কারো উস্কানিতে আন্দোলন করলে, পুলিশের সাথে মারামারি করলে, ভিসির বাসায় তাণ্ডব করলে, মুক্তিযোদ্ধাদের রাজপথে হেয় করলেই তাদের অন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে? কয়েকজন ছাত্রী বলেছেন, তারা কোটা চান না। কয়েকজন আদিবাসী বলেছেন, তারা কোটা চান না। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ হয়তো অভিমান করে বলেছেন, তারা কোটা চান না। কিন্তু এই কয়েকজন নারী বা আদিবাসী বা মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরি তো তাদের গোষ্ঠির সবার প্রতিনিধিত্ব করেন না। সেই দায়িত্বও কেউ তাদের দেয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীদের আন্দোলন দেখে গ্রামের কলেজের ছাত্রীটিকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আবার কোটা চাইতে হলে, আন্দোলন করে তা আদায় করে নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। আন্দোলনের তীব্রতা কখনো দাবি আদায়ের পূর্বশর্ত হতে পারে না। দাবি ন্যায্য কিনা সেটাই বিবেচ্য হতে হবে।
সংখ্যাগুরু মানুষ নির্বাচনের আগে গায়ের জোরে রাস্তা দখল করে আন্দোলন করলেই কি তা মানতে হবে? আর আদিবাসী, প্রতিবন্ধীরা তো দুর্বল, সংখ্যায় কম। তারা তো তীব্র আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে পারবে না। সমাজের অগ্রসর-সংখ্যাগুরু অংশ যদি অনগ্রসর-সংখ্যালঘু মানুষের দাবিতে ঊর্ধ্বে তুলে না ধরে, যদি তাদের পাশে না দাঁড়ায়; রাষ্ট্রকে অবশ্যই দুর্বলদের পাশে থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু শিখিয়ে গেছেন, দাবি যদি ন্যায্য হয়, একজন করলেও সেটা মানতে হবে। তাই কোটার বিষয়টা আন্দোলন দিয়ে নয়, ন্যায্যতা দিয়ে পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।
এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু এস কে সিনহা প্রসঙ্গেই শেখ হাসিনা সবচেয়ে মিতভাষী। এস কে সিনহার দুর্নীতি প্রসঙ্গে লম্বা প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি এক লাইনে, 'ল উইল টেক ইট ওন কোর্স।' সংক্ষিপ্ত উত্তরে সাংবাদিকদের অতৃপ্তি দেখেও মজা করতে ছাড়েন না, 'আমি কম কথা বললেও দোষ, বেশি বললেও দোষ।' এস কে সিনহা নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, দেশের প্রথম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান বিচারপতি করা হলেও তিনি সে মর্যাদা রাখতে পারেননি।
এস কে সিনহা প্রশ্নে মিতভাষী প্রধানমন্ত্রী আবার রাজনীতি প্রসঙ্গে প্রগলভ। ষড়যন্ত্রের শঙ্কার জবাবে বলেছেন, বাংলাদেশ ষড়যন্ত্রের উর্বর ভূমি। যারা নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে পারে না, তারাই ষড়যন্ত্র করে গাড়িতে পতাকা লাগাতে চায়। সরকার বিরোধী জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শত ফুল ফুটতে দিন। অল্প কথায় তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির আসল চেহারাটা তুলে ধরেছেন।
'বাংলাদেশে ভোট হয় আওয়ামী লীগ আর এন্টি আওয়ামী লীগ। এন্টি আওয়ামী লীগ যারা, তাদের তো যাওয়ার একটা জায়গা লাগবে।' তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বা অন্য কোনো মাঠে সভা-সমাবেশে সবার গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রাখার কথা বলেন। হাসতে হাসতে বলেন, প্রয়োজনে তাদের সমাবেশে লোকও দেবেন তিনি। জাতিসংঘে বিদেশী রাষ্ট্রনায়কেরা ব্যক্তিগত সাক্ষাতে তাকেই আবার ক্ষমতায় দেখতে চাওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, তবে আমি কাউকে বলিনি, আপনি এসে আমাকে গদিতে বসিয়ে দিন। ভারতের কাছে এস কে সিনহার তদ্বির প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, বাইরের কারো মুখাপেক্ষী হয়ে ক্ষমতায় থাকতে চান না তিনি।
ক্ষমতা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি চেয়েছিলেন, পরপর দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকতে, যাতে উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়। সেটা হয়েছে। এখন ক্ষমতা হলো থাকে লক্ষ্মী, যায় বালাই। বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে তো বটেই, ইদানীং বারবার শেখ হাসিনার কণ্ঠে একটা কথা ফুটে উঠছে, জনগণ ভোট দিলে আছি, নাইলে নাই। এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা।
প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে সবাই অংশ নেবে। আমরাও চাই, নির্বাচনে সবাই অংশ নিক। আর নির্বাচন শুধু অংশগ্রহণমূলক নয়; সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হোক। গণতন্ত্রের শত ফুল ফুটুক। জনগণ বেছে নিক তাদের পছন্দের ব্যক্তি ও দলকে।৪ অক্টোবর, ২০১৮
এইচআর/পিআর