চলমান সময়ে সম্ভাবনাময় শিল্প পর্যটন। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নীল জলরাশি আর সবুজ পাহাড়ের সম্মিলনে নয়নাভিরাম প্রকৃতিকে ঘিরে বিগত একযুগে এ শিল্প বিকাশে বিভিন্ন কাজ করছে সরকার। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শত কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ, রেললাইন প্রকল্প, সৈকতে শহর রক্ষাবাঁধ, বিকল্প সড়ক, সবুজ পার্ক, মাতারবাড়ি বিদ্যুত প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, সাবরাং ও সোনাদিয়ায় এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোনসহ নানা মেগাপ্রকল্পে ধীরে ধীরে দেশের পর্যটন রাজধানী হয়ে উঠছে কক্সবাজার।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিক ১২টিসহ ৬৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শেখ হাসিনা সরকার। প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার চলমান এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে পাল্টে যাবে পুরো কক্সবাজারের পর্যটনের চেহারা। এভাবে কক্সবাজার হবে জাতীয় অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু।
স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে কক্সবাজারের সংসদীয় আসনগুলো জামায়াত-বিএনপির দখলে ছিল। এসময় ধর্মভীরু ও কৃষিনির্ভর লোকজনকে নানা কায়দায় ভুলিয়ে ভোট কব্জায় নিলেও কক্সবাজারের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নজর দেয়নি তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা। শেষমেষ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বিকাশে নানা উদ্যোগ হাতে নেয়। একের পর এক নেয়া হয়েছে মেগাপ্রকল্প। বর্তমানে এটি কম-বেশি ৩ লাখ কোটি টাকার প্রকল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। ইতোমধ্যে মেরিনড্রাইন রোডের সুফল ভোগ করছে পর্যটক ও স্থানীয়রা। বাকি প্রকল্পের কিছু অর্ধেক, কিছু দুই-তৃতীয়াংশ বা কিছু এক তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হয়েছে অথবা চলমান রয়েছে।
এত সংখ্যক প্রকল্প চালু থাকলেও কক্সবাজারের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আমজনতা এসব প্রকল্প সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। অসচেতনতা ও সরকারের তরফ থেকে যথাযত প্রচারণা না থাকায় এমনটি হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর তাই সারা দেশব্যাপী বর্তমান সরকারের চলমান ও সমাপ্ত হওয়া বা শুরু হতে যাওয়া প্রকল্প সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে গত কয়েক বছর ধরে চালানো হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন মেলা। এরই ধারাবাহিকতায় এবার এ মেলা শুরু হলো আজ ৪ অক্টোবর থেকে, চলবে ৬ অক্টোবর রাত পর্যন্ত।
Advertisement
পর্যটন রাজধানী হিসেবে কক্সবাজারের মেলাটি হবে একেবারে ব্যতিক্রম। কক্সবাজার সার্কিট হাউস সংলগ্ন গোলচক্কর মাঠে চলবে এবারের মেলা।
এসব বিষয় জানাতে মঙ্গলবার প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। সেখানে জানানো হয়, ৬৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ১৩ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। দু’একটি ছাড়া বেশির ভাগ প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দ্রুত চলছে।
চলমান প্রকল্পের মাঝে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সবচেয়ে বড়। ১২’শ মেগাওয়াট উৎপাধন ক্ষমতাসম্পন্ন এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ৭০ ভাগ সম্পন্ন হওয়া এ প্রকল্প সম্পন্ন হলে ২০২১ সালে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা যাবে।
ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে রাস্তার উন্নয়ন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, কয়লা আনলোডের জন্য জেটিসহ প্রায় কাজ শেষ হয়েছে। ২০২১ সালে পুরোদমে এ কেন্দ্রটি চালুর পর ২০২৪ সালে চালু হবে আরও একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পন্ন হয়ে চালু হলে পাওয়ারের মূল কেন্দ্রে পরিণত হবে মহেশখালী।
Advertisement
এদিকে মহেশখালীতেও সফলতার মুখ দেখেছে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প। গতমাস থেকে এ টার্মিনাল দিয়ে এলএনজি গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। এখন আনোয়ারা হয়ে প্রতিদিন ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। শিগগিরই এটি দিনে ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
একইভাবে মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড, সোনায়াদিয়া বঙ্গবন্ধু গভীর সমুদ্র বন্দর, সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক, ধলঘাটা ও মাতারবাড়ির মাঝখানে বাণিজ্যিক বন্দরসহ চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল মিলে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে মহেশখালীতে।
অপরদিকে কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ‘রেল লাইন’ প্রকল্প দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটারের সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেইজ রেলপথের নির্মাণ কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে পর্যটন শহরে রেলের আগমন ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, জালিয়ার দ্বীপ এক্সক্লুসিভ নাফ ট্যুরিজম পার্ক, সাবরাং অর্থনৈতিক জোনসহ পুরো জেলায় চলছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, বর্তমানে দেশের এক বছরের বাজেটের প্রায় ৭০ ভাগ টাকার পরিমাণ উন্নয়ন কাজ চলছে কক্সবাজারে। কিন্তু এখানকার মানুষ এসব উন্নয়ন থেকে কি সুফল পাবে বা কেন এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেই সম্পর্কেও খুব বেশি জানে না। এমনও অনেকে আছে যারা এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো ধারণাই রাখে না। জনগণের সামনে সরকারের এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য এবার ব্যতিক্রম উন্নয়ন মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
মেলায় প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও আজকের বাংলাদেশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও শিক্ষিত জাতি সমৃদ্ধ দেশ-শেখ হাসিনার বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা হবে।
তিনদিনের মেলায় সন্ধ্যার পর দেশের বিখ্যাত ব্যান্ড সোলস, খ্যাতনামা শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন, বাউল শিল্পী রিংকু, প্রতীক হাসানসহ দেশসেরা শিল্পীরা গান পরিবেশন করে মঞ্চ মাতাবেন।
এছাড়াও থাকবে রাখাইন ও স্থানীয় শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে রিয়েলিটি শো, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। মেলার শেষ দিনে থাকবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের লেজার শো এবং আতশবাজি।
শুধু আয়োজনস্থলে সীমাবদ্ধ থাকবে না এবারের উন্নয়ন মেলা। ডিজিটাল ভ্যানের মাধ্যমে শহরে প্রদর্শন করা হবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং মেগা প্রকল্প সমূহের চিত্র। এছাড়া উন্নয়নের খবর মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে জেলার ৭১টি ইউনিয়নে বড় এলইডি স্ক্রিনের সাহায্যে উন্নয়নের চিত্র দেখানো হবে বলেও জানান তিনি।
সায়ীদ আলমগীর/এফএ/পিআর