বিশেষ প্রতিবেদন

৫ হাজার মিলিয়ন ডলারের বাজারে নেই বাংলাদেশ

বিশ্বে দিন দিন বাড়ছে সাপের বিষের চাহিদা। বিষের পাশাপাশি সাপের চামড়া ও মাংসের বাজারও বিশ্বব্যাপী। সাপের চামড়ার বাজার শুধু এশিয়ায় ছয়শ মিলিয়ন ডলারের। মাংসের বাজারও প্রায় সমপরিমাণের।

Advertisement

বর্তমানে সাপের বিষের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ডলার। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি মার্কেট রিসার্চ (টিএমআর) বলছে, ২০২৫ সালে এই বাজার দুই হাজার ৯৪৬ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। একই সঙ্গে চামড়া ও মাংসের বাজার ধরলে এ সংখ্যা পাঁচ হাজার মিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিশাল এই আন্তর্জাতিক বাজারে এখনও আমরা প্রবেশ করতে পারিনি।

আরও পড়ুন >> সাপের খামার এখন গলার কাঁটা

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে সাপের খামারের কোনো অনুমতি দেয়া হয় না। সাপ অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী, যদিও বাংলাদেশে অবহেলা আর সচেতনতার অভাবে যত্রতত্র সাপ মেরে ফেলা হচ্ছে। এতে প্রকৃতির ভারসাম্য যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি নষ্ট হচ্ছে মিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা। এটি হতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের অন্যতম বড় খাত।

Advertisement

টিএমআর’র তথ্য মতে, দিন দিন বিশ্বে সাপে কাটা রোগীদের জন্য ব্যবহৃত ভ্যাকসিন ‘এন্টিভেনম’ তৈরিসহ বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে বাড়ছে সাপের বিষের ব্যবহার। ২০১৬ সালে সাপের বিষের আন্তর্জাতিক বাজার ছিল এক হাজার ৬৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সালে তা পৌঁছবে দুই হাজার ৯৪৬ মিলিয়ন ডলারে। শুধু সাপের বিষ নয়, সাপের চামড়ার বাজার শুধু এশিয়ায় ৬২৫ মিলিয়ন ডলারের। চামড়া থেকেও বড় বাজার সাপের মাংসের। সাপের চামড়ার গ্রাহক সাধারণত আরবের শেখ ও শৌখিন মানুষ। সরকারি সিদ্ধান্ত না এলেও চোরাকারবারিরা ঠিকই চোরাইপথে প্রতি বছর সাপের বড় বড় চালান চীন, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাজারে পাঠাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক দূর এগিয়েছিল সাপের খামারের অনুমতির কার্যক্রম। কিন্তু তা থমকে গেছে। বাংলাদেশে প্রথম সাপের খামারের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নেয়া হয় ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের তোতা মিয়াকে দিয়ে। কিন্তু খামার নির্মাণের দুই বছরের মাথায় তোতা মিয়া সাপের কামড়ে মারা গেলে সরকার খামারিদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পিছিয়ে আসে।

তবে বর্তমানে শিক্ষিত অনেক যুবক নিজ উদ্যোগে খামার করছেন। তারা বলছেন, তোতা মিয়া ছিলেন অশিক্ষিত এবং খামারের যে অবকাঠামো দরকার তা তার ছিল না। তিনি বিষধর জেনেও গলায় একটা সাপ পেঁচিয়ে রাখতেন। বিষদাঁত ভেঙে সাপ গলায় রাখা যায় কিন্তু ১৫ দিন পর আবার সেই দাঁত গজায়। এই ধারণা তার ছিল না এবং কামড় খাওয়ার পরও যথাযথ চিকিৎসা নেননি।

আরও পড়ুন >> আশীর্বাদ হতে পারে সাপের বিষ

Advertisement

তারা আরও জানান, বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সাপের বিষসহ মাংস ও চামড়ার গুণগত মান অনেক ভালো। এ কারণে এর চাহিদাও বিশ্বব্যাপী। সাপের খামারের জন্য বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ভালো। একশ সাপের খামার তৈরিতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ২-৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। এটি করতে অন্যান্য দেশে প্রয়োজন কমপক্ষে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা। ইনভেস্টমেন্ট কম হওয়ার কারণ হলো আবহাওয়াগত সুবিধা। শুধু একটি রাসেল ভাইপার সাপ থেকে বছরে ছয় লাখ টাকার বিষ বিক্রি করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের এক গ্রাম সাপের বিষের মূল্য প্রজাতি ভেদে দুই থেকে চার লাখ টাকা। সাপের চামড়া ও মাংসের মূল্যও অনেক।

এতো সম্ভাবনার পরও বাংলাদেশে সাপের খামারের অনুমতি দিচ্ছে না সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ব্রাজিল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, চীন, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ সাপের বিষ বাজারজাত করে তাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা এখনও কোনো উদ্যোগ নিতে পারিনি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাপের খামারের অনুমতি দিলে জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) মোটা দাগে ভূমিকা রাখবে এ সেক্টর। আমাদের বিশাল সাগর কাজে লাগিয়ে যে ব্লু-ইকোনমির কথা ভাবছে সরকার তাতেও গতি এনে দিতে পারে সাপের বিষ। কারণ সাগরের বিষাক্ত সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করা গেলে তা মাছের উৎপাদনের আয়কেও ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাপের খামার গড়ে তুলেছেন কয়েকজন শিক্ষিত যুবক। তারা জানান, সাপের প্রতি ভালোবাসা থেকে খামার তৈরি। সাপ দেশের অমূল্য সম্পদ, কিন্তু মানুষ সাপ দেখলেই মেরে ফেলে। মানুষের হাত থেকে সরীসৃপ এই প্রাণীকে বাঁচাতে সেটি উদ্ধারের পর নিজের হেফাজতে রাখতে গিয়েই খামারে রূপ নেয়া।

আরও পড়ুন >> বিষধর সাপের নাম রাসেল ভাইপার

এমন এক খামারি রাজবাড়ীর রনজু মল্লিক। তিনি বলেন, সাপের নিরাপত্তা এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমার এই খামার। সরকারি অনুমতি পেলে খামারের মাধ্যমে নিজের যেমন উন্নয়ন সম্ভব তেমনি অনেকের কর্মসংস্থানও সম্ভব। রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পাবে।

‘অবহেলিত এই খাত পরিচালনা করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে নতুনমাত্রা যুক্ত হবে এবং বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নতুন আরেকটা উন্নয়নের অধ্যায় তৈরি হবে’- যোগ করেন তিনি।

রাজশাহীতে প্রতি বছর মানুষের হাতে অসংখ্য সাপ মারা যায়। এমন কিছু সাপ মানুষ কাছ থেকে উদ্ধার করে নিজের হেফাজতে রেখেছেন বোরহান বিশ্বাস রোমন। তিনি বলেন, আমার এলাকায় কোনো বনাঞ্চল নেই, যেখানে সাপ অবমুক্ত করা যায়। এ কারণে উদ্ধার করা সাপ নিজের কাছে রাখছি।

তিনি আরও বলেন, ‘সাপগুলো লালন-পালনে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। সেগুলো ছেড়ে দেয়ারও কোনো জায়গা নেই। মানুষ দেখতে পেলেই মেরে ফেলবে, তাই বাধ্য হচ্ছি নিজের কাছে রাখতে।’

‘বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে সাপের খামার করে সফল হয়েছে। সব বিষয় বিবেচনা করে যদি সরকার খামার তৈরিতে অনুমতি দেয় তাহলে আমরাও সফল হবো। আমাদের দেশের সাপের বিষ, চামড়া ও মাংসের কোয়ালিটি অনেক উন্নত। তবে খামার করার আগে অবশ্যই যথাযথ ট্রেনিং নিতে হবে এবং শিক্ষিত তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও গুরুত্বপূর্ণ।’

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আবু রেজা জাগো নিউজকে বলেন, “আমি ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছি যে, বাংলাদেশে যে এন্টিভেনাম বাইরে থেকে আসে তার ৫০ শতাংশই অকার্যকর। ফলে রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় সফলতা আসে না। আমাদের দেশের সাপের বিষের মান অনেক ভালো, যা রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। এছাড়া আমরা নিজেরাও ভ্যাকসিন ‘এন্টিভেনম’ উৎপাদন করতে পারি।”

‘খামারের অনুমতি দিলে সাপের চোরাচালান যেমন বন্ধ হবে তেমনি রক্ষা পাবে পরিবেশ। কারণ সাপের খামার হলে মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। নিরীহ এ প্রাণীকে কেউ যথেচ্ছা হত্যা করতে যাবে না। খামার থেকে প্রচুর সাপ জন্ম নেবে এবং প্রকৃতির ভারসাম্যও রক্ষা পাবে।’

অর্থনীতিতে সাপের প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির জন্য সাপের খামার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হবে। শুধু আমদানি নয়, আমাদের রফতানির বাজারও তৈরি করতে হবে। লেদার, সিরামিক, টেক্সটাইলের পাশাপাশি এই শিল্প আমাদের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হবে। তবে এজন্য নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করতে হবে। কারণ একে তো বিষধর তার ওপর পরিবেশের ওপর আঘাত আসে কিনা- তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।’

সাপের খামারের অনুমতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের পরিচালক মিহির কুমার দে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে সাপ পালন বন্যপ্রাণী আইনে অপরাধ; তবে ইতোমধ্যে বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি খসড়া নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যদি তা কার্যকর হয় তবে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালার আলোকে বাধ্যবাধকতামূলক বন বিভাগ সাপের খামারের অনুমতি দেবে।’

এমবিআর/এমএআর/পিআর