মা কল্পনা চট্টোপাধ্যায় বেশ কয়েকদিন ধরেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি রয়েছেন। দিনের বেলা মায়ের দেখভাল করেন। রাতটায় কলেজ চত্বরেই শুয়েই কাটিয়ে দেন বর্ধমানের গুড়াপের বাসিন্দা কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু, বুধবার সকালে আচমকাই ঘুম ভাঙতে দেখেন, যে ওয়ার্ডে তার মা ভর্তি রয়েছেন, সেই মেডিসিন বিভাগ থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান তিনি।
Advertisement
চিৎকার করে হাসপাতালে কর্মীদের জানান দেন, আগুন লেগেছে। কোনো রকমে মায়ের বেডের কাছে পৌঁছান কেদারনাথ। তারপর নিজেই পাঁজাকোলা করে সত্তর বছরের মাকে তুলে নেন। তারপর বাইরে বেরিয়ে আসেন। কেদারনাথের কথায়, ‘ভেতরে তখন অন্য রোগীরা আতঙ্কে চিৎকার করছেন। মাকে বাইরে নিরাপদ জায়গায় রেখে ফের ছুটে যাই। আরও কয়েকজন রোগীকে ওভাবেই বাইরে নিয়ে আসি। আমরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করার পর হাসপাতালে গ্রুপ ডি কর্মীরা এসে রোগী উদ্ধারের কাজ শুরু করেন।’
এদিন সকাল ৮টা নাগাদ যখন মেডিকেল কলেজে আগুন লাগে, রমেশ রঞ্জিত তখন দাদার জন্য ওষুধ কিনতে বাইরে বেরিয়ে ছিলেন। দাদা বাসুদেব রঞ্জিত ডেঙ্গু নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে মেডিকলে কলেজে ভর্তি। চিকিৎসকেরা তাকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায়। কারণ, ৪৫ বছর বয়সী বাসুদেবের জ্বর কিছুতেই নামছে না। আগুন লাগার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে আসেন রমেশ। ততক্ষণে হাসপাতালে হুড়োহুড়ি বেধে গিয়েছে। দাদাকে কীভাবে উদ্ধার করবেন, সেই আতঙ্কে কান্নাকাটি শুরু করে দেন তিনি।
রমেশ বলেন, ‘তখনই এগিয়ে আসেন হাসপাতালেরই এক গ্রুপ ডি কর্মী। আমাকে নিয়ে সোজা উঠে যান মেডিসিন বিভাগের পাশের ওয়ার্ডে। দুজনে মিলে মুখে অক্সিজেন মাস্ক বাঁধা দাদাকে বাইরে বার করে আনি।’ এরপর বাসুদেবকে নিয়ে যাওয়া হয় ইমার্জেন্সি বিভাগে।
Advertisement
একই অভিজ্ঞতা উপেন্দ্রকুমার প্রসাদের। কলেজ স্ট্রিট এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে তাদের পরিবার। পায়ে ব্যথা নিয়ে তার দাদা কয়েকদিন আগে ভর্তি হন মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে। এদিন সকালে উপেন্দ্রকুমার দাদাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিলেন। ঠিক সেইসময়ে ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করে মেডিসিন বিভাগে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দাদাকে কোনো রকমে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিচে নামিয়ে আনেন তিনি।
উপেন্দ্রকুমারের কথায়, ‘কোথায় আগুন লেগেছিল জানি না। কিন্তু, দাদাদের ওয়ার্ডটা পুরো কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল। কীভাবে যে ওকে নিয়ে বাইরে নিয়ে এসেছি, তা ঈশ্বরই জানেন!’
বুধবার সকালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (এমসিএইচ) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালের নিরাপত্তা রক্ষী এবং রোগীর স্বজনরা প্রথম ধোঁয়া দেখতে পান এমসিএইচ বিল্ডিংয়ে। সেই আগুনের উৎস বোঝার আগেই গাঢ় কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে গোটা হাসপাতাল জুড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে রোগী এবং তাদের আত্মীয়দের মধ্যে। এমসিএইচ বিল্ডিংয়ে রয়েছে কার্ডিওলজি, আইসিইউ, পুরুষ এবং নারীদের মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড।
হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীরা প্রথমে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। ঘটনাস্থলে প্রথমে দমকলের চারটি ইউনিট পৌঁছায়। পরে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আরও ছয়টি ইউনিট আনা হয়। কিন্তু ততক্ষণে গোটা হাসপাতাল চত্বর প্রচন্ড ধোঁয়াতে ঢেকে যায়। ওষুধের দোকানের শাটার ও কাচ ভেঙে ভিতরে ঢুকে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায় দমকল বাহিনী। ইতোমধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন দমকলমন্ত্রী তথা মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
Advertisement
সেই ধোঁয়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঢোকা শুরু হয়। অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন রোগীরা। এদের অনেকেরই অক্সিজেন চলছিল। তড়িঘড়ি হাসপাতাল কর্মীরা এবং দমকল কর্মীরা সেই সব রোগীর একটা বড় অংশকে ওয়ার্ড থেকে নিচে নামিয়ে আনেন। এ কাজে হাতে হাত লাগান রোগীর আত্মীয়রাও।
রোগীদের নামিয়ে আনার সময় অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত স্ট্রেচারও পাওয়া যায়নি। চাদরে করে রোগীদের নিয়ে আসতে দেখা যায়। প্রথম অবস্থায় আইসিইউ-তে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কিছু রোগীকে। সেখানে স্থান সঙ্কুলান না হলে তাদের খোলা আকাশের নিচে মাটিতে চাদর পেতে রাখা হয়।
প্রাথমিক ভাবে দমকল সূত্রে জানা গেছে, এমসিএইচ বিল্ডিংয়ে কোনও ওষুধের কাউন্টারে আগুন লেগেছে। বেশি ধোঁয়া থাকায় দমকল কর্মীরাও ভেতরে ঢুকতে পারছিলেন না। পরে গ্যাস মাস্ক পরে তারা বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢোকেন। এখনও আগুন নেভানোর কাজ চলছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরাও। আনন্দবাজার
এসআর/জেআইএম