দালালদের প্রলভনে সুখের আশা, দাদন ব্যবসায়ীদের চাপ, মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাড় এমনকি জুয়ার টাকা সংগ্রহ করতেও শরীরের মূল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করেছেন মানুষগুলো। এতে সামান্য পরিমাণ নগদ অর্থ পেলেও দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে মোটা অঙ্ক। ফলে এলাকার অনেক কিডনি দালালই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। অপরদিকে রোগে শোকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন সেসব কিডনি বিক্রেতারা।
Advertisement
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মাত্রাই, উদয়পুর, আহমেদাবাদ ইউনিয়নের ২০ গ্রামের এমন চিত্র সবার জানা থাকলেও থেমে নেই কিডনি পাচার চক্রের অপতৎপরতা। মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯ এর ৯ ধারায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচা-কেনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের ঝিমিয়ে পড়ার সুযোগে দালালদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে এখন মৃত্যুমুখে এসব মানুষ।
২০১১ সালের ২৯ আগস্ট ২০ গ্রামের দুই শতাধিক অভাবি মানুষের কিডনি বিক্রি করার খবর গণমাধ্যমে প্রচার হলে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে মাঠে নামে পুলিশ প্রশাসন। একাধিক দালাল এবং কিডনি বিক্রেতা স্পষ্টভাবে এ অপরাধ চক্রের সঙ্গে ঢাকার নামকরা হাসপাতাল, ক্ষমতাধর কিডনি গ্রহিতা, রাঘব-বোয়ালদের নাম এবং স্বনামধন্য চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততার কথা উপস্থাপন করলেও তারা থেকে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই।
কিডনি চক্রের দালাল, অভাবি বিক্রেতা ও এরসঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত থানায় ৪টি মামলা হলেও আইনের ফাঁকে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও তারা সক্রিয় হয়ে উঠছেন। ফিরে যাচ্ছেন পুরনো পেশায়। এমনকি অনেক কিডনি বিক্রেতাই দালালে পরিণত হয়েছে। গ্রামের সহজ-সরল অভাবি মানুষদের বুঝিয়েছে একটি কিডনি দিলে কোনো ক্ষতি হয় না।
Advertisement
কয়েক বছর ধরে কিডনি বিক্রির খবর শোনা না গেলেও সম্প্রতি কালাই থানার পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে দালাল চক্রের সদস্য ওই উপজেলার বাগইল গ্রামের মুনছুর রহমানের ছেলে জুয়েল রানা (৩৩) ও মোহাইল গ্রামের মিজানুর রহমানের স্ত্রী ও কিডনি বিক্রেতা হেলেনা বেগমকে (৩০) গ্রেফতার করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে পুনরায় বেরিয়ে আসে কিডনি বিক্রির ঘটনা।
গ্রেফতার দালাল জুয়েল রানা জানান, অভাবে পড়ে নিজে কিডনি বিক্রি করেছি। এখন কিডনি কেনাবেচায় সহযোগিতা করছি।
হেলেনা বেগম বলেন, সংসারে অভাবের কারণে জুয়েলের সঙ্গে প্রথমে ঢাকায় যাই। পরে আড়াই লাখ টাকায় কিডনি দিতে রাজি হই। ভারতে গিয়ে ঢাকার এক লোককে কিডনি দেই। কয়েকদিন আগে বাড়িতে আসছি।
কিডনি বিক্রি চক্রের গ্রেফতারকৃত দালাল জুয়েল রানা
Advertisement
এরপর উপজেলার পশ্চিম বিনইল আবাসন থেকে গ্রেফতার করা হয় মৃত ময়েজ উদ্দিনের ছেলে দুলাল মিয়া (৪৫) নামের একজন কিডনি বিক্রেতাকে। দুলাল মিয়া জানান, দাদন ব্যবসায়ীতের কাছে তার ঋণের দুর্বলতার সুযোগ নেন একই গ্রামের কিডনি দালাল কাউছার। দালালের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দু’মাস আগে ৬ লাখ টাকা চুক্তিতে কুমিল্লার মাহবুবুল আলম সিদ্দিকী নামে এক প্রকৌশলীর কাছে কিডনি বিক্রি করেন। কিন্তু বিনিময়ে পান মাত্র ৮০ হাজার টাকা। বাকী টাকার কথা কিডনি গ্রহীতার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে কাউছারকে সব টাকা দেয়া হয়েছে বলে জানান। কাউছারের সঙ্গে টাকার জন্য যোগাযোগ করলে সে বিভিন্ন রকম ভয়-ভীতি দেখায় এবং মেরে ফেলার হুমকিও দেয়।
তিনি আক্ষেপ এই টাকায় আমার দেনাও মিটেনি, অভাবও ঘোচেনি। বরং কিডনি বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাজ করার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছি।
তিনি আরও জানান, প্রায় চার মাস ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে ভারতের ফোর্টিস হাসপাতালে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এ জন্য কুমিল্লার প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে তার ছোট ভাইয়ের সম্পর্ক দেখানো হয়। তার নাম ঠিক রেখে কুমিল্লার ঠিকানায় আইডিসহ যাবতীয় কাগজপত্র জালিয়াতি করে তৈরিও করা হয় বলে জানান তিনি।
সরেজমিনে ওই এলাকা ঘুরে জানা গেছে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কিডনি বিক্রেতারা বর্তমানে ভালো নেই। ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে যে মানুষগুলো একটু উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখেছিল, তারা এখন রোগ শোকে কর্মশক্তি হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ৫ থেকে ৭ বছর আগে কিডনি দেয়া এ মানুষগুলো এখন নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছেন।
এদের কোমরে ব্যাথা হয়, মাঝে মধ্যেই জ্বর হয়, প্রস্রাবে জ্বালা যন্ত্রণাও হয়। একটু হাঁটাচলা করলেই শাসকষ্ট দেখা দেয়। ভারি কাজ একেবারেই করতে পারছেন না তারা। এছাড়া সমাজে কিডনি বিক্রি করা মানুষ হিসেবেও হেয় হচ্ছেন।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ভেরেন্ডি গ্রামের আকতার আলম জানান, তিনি ২০০৯ সালে দালালের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রি করেছিলেন। ৪ লাখ টাকা কিডনির দাম ঠিকঠাক হলেও প্রতারণার শিকার হয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। এ দিয়ে ৫টি এনজিওর ঋণের আসল টাকা পরিশোধ করেছেন। এখনো গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি টানছেন। এখন পাড়ার ছেলেরা ছোট একটি দোকান করে দিয়েছে তাকে। এ দিয়েই দুমুঠো খেয়ে ২ সন্তান নিয়ে অভাবের মধ্যে দিন কাটছে তার।
তার জীবনের ভুল কাজের অনুশোচনা করে তিনি বলেন, আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে, কখনো ভ্যান চালিয়ে, রোজগার করতাম। দিনে ১শ টাকা পেলেও শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলাম। আর ওই পরিমাণ টাকা তো পাই না, তার ওপর ওষুধ কিনতে হচ্ছে প্রতিমাসেই।
কেবল আকতার আলমই নয় একই ধরনের কথা বলেন, উপজেলার বোড়াই গ্রামের কিডনি বিক্রেতা দম্পতি বেলাল উদ্দিন ও জোসনা বেগম, আইনুল, ভেরেন্ডির আক্তারুজ্জামান, উলিপুর গ্রামের আজাদুল ও বাগইলের মিজানসহ অনেকেই।
কালাই পৌরসভার মেয়র হালিমুল আলম জন বলেন, কিডনি বিক্রি এখনও থেমে নেই। কয়েক মাস আগে তিনি ভারতের এক হাসপাতালে গিয়েও এলাকার লোককে কিডনি বিক্রির জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে দেখেছেন।
মাত্রাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ.ন.ম শওকত হাবিব তালুকদার লজিক জানান, কয়েক বছর আগে কিডনি বিক্রির যে প্রবণতা ছিল, তা কমে গেছে। কিডনি বিক্রি রোধে তারা জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে কালাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ খান বলেন, প্রচলিত ফৌজদারি আইনে মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিডনি বিক্রি বন্ধে যা যা করা দরকার সবই করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দালাল ও বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দেওয়া হয়েছে। কিডনি বিক্রেতারা যাতে পরবর্তীতে দালালের কাজ করতে না পারে এজন্য তাদের সঙ্গে থানার সংশ্লিষ্টতা রাখা হয়েছে এবং প্রায়ই তাদেরকে ডেকে গ্রামে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার জানান, একটি কিডনি দিয়েও মানুষ চলতে পারে। কিন্তু অপুষ্টির জন্য কিডনি দাতারা অসুখে পড়তে পারেন। আমাদের কাছে এলে অবশ্যই তাদের চিকিৎসা দেয়া হবে।
রাশেদুজ্জামান/এফএ/পিআর