বিশেষ প্রতিবেদন

এরশাদ-রওশন দ্বন্দ্বে জাপায় অস্থিরতা!

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের দ্বন্দ্বে দলটিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন সংসদের বিরোধী দলের শীর্ষ দুই নেতা। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

Advertisement

দলটির নীতিনির্ধারণী নেতাদের ভাষ্য মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, না করা নিয়ে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত। ওই নির্বাচনে এরশাদের কথায় রাতারাতি ২১৭ প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এরশাদের নির্দেশ অমান্যকারীদের বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করা হলেও নির্দেশ মেনে যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন তাদের বিভিন্ন জেলার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

আরও পড়ুন >> আ.লীগের কাছে ১০০ আসন চেয়ে তালিকা দিয়েছি : এরশাদ

দলটির নেতারা জানান, গত ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বৈঠকে জাপা মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু ও কাজী ফিরোজ রশিদ উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বৈঠকের বিষয়টি জানতেন না বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।

Advertisement

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাপার এক নেতা জানান, বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে না আনার কারণ জানতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অপরদিকে এরশাদ নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় তিনজনের নাম প্রস্তাব করেন।

বৈঠকে জাতীয় পার্টির এক নেতাকে অন্য দলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয় বলে দাবি ওই নেতার।

জাতীয় পার্টির নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি না জানাকে কেন্দ্র করে এবারের বিরোধ। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের কাছে জানতে চান রওশন এরশাদ। তিনি (রওশন এরশাদ) বৈঠকের বিষয়টি না জানায় জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য ক্ষুব্ধ হন। পরবর্তীতে (১৯ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন।

আরও পড়ুন >> ‘দেশ ঠিকভাবে চলছে না, বলার সাহস নেই কারও’

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, এরশাদ আমাদের নেত্রী রওশন এরশাদকে না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রওশন এরশাদ একান্তে বৈঠক করেন। বৈঠকে আগামী নির্বাচনে জাপার আসন সংখ্যা, নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

Advertisement

জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতার দাবি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ নির্বাচনকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ ও জিয়াউদ্দীন আহমেদ বাবলুর নাম প্রস্তাব করেন।

চেয়ারম্যানের ওই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

জাপার ওই নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, রওশন এরশাদ নির্বাচনকালীন সরকারে সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামসহ অন্যদের নাম প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমরকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ করারও প্রস্তাব করেন রওশন। পরবর্তীতে নুরুল ইসলাম ওমর বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পান।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে তলব করে। দলটির এরশাদপন্থী নেতাদের দাবি, পার্টির মহাসচিব সরকারবিরোধী জোটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন- এমন তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দুদক থেকে পাওয়া চিঠি সেই ইঙ্গিত বহন করে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদ হারানোর আগেও দুদক থেকে একই কায়দায় চিঠি পেয়েছিলেন হাওলাদার। এদিকে গত ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটিতে অনুষ্ঠিত জাপার ডিজিটাল নির্বাচনী প্রচারণা কর্মশালায় রওশন এরশাদসহ দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন না বলে জানা গেছে। রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির নেতারা মনে করেন, দলের মহাসচিব এরশাদ ও রওশনের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছেন। নিজেদের সংসদ সদস্য পদ টিকিয়ে রাখতে বিপাকে পড়েছেন দলের সংসদ সদস্যরা। আগামীতে কার নেতৃত্বে আসন নির্ধারণ হবে তা কেউ নিশ্চিত নন। তাই তারা দু-কূলই রক্ষা করে চলছেন।

আরও পড়ুন >> আ.লীগের ছেলেরা ধর্ষণ করে আর ছবি তোলে : এরশাদ

জাতীয় পার্টির এক নেতা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে এক প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে থাকতে বলেছেন। খুব শিগগিরই দলের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ওই প্রতিমন্ত্রী বসবেন বলে জানা গেছে।

জাতীয় পার্টির নীতিনির্ধারণী এক নেতা জানান, নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির এই অবস্থান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়েও জাতীয় পার্টি নিয়ে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।

জাপার ওই নীতিনির্ধারণী নেতা দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান এরশাদ ও রওশন দু’জনে মিলে দলের হাল ধরুক। আস্থার সংকট কাটিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ ও বিরোধী দলের নেতা রওশনকে একই প্লাটফর্মে আনা যায় কিনা- এমন চেষ্টা করতে জাপার এক শীর্ষ নেতা ও প্রতিমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন বলে ওই নেতার দাবি।

আরও পড়ুন >> আর কারও ক্ষমতার সিঁড়ি হবো না : রওশন এরশাদ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, বিগত নির্বাচনের পর থেকে দলে এক ধরনের বিভেদ চলছিল। যারা তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা এবার আর ক্ষতির মুখে পড়তে চাইছেন না।

‘এরশাদ-রওশনের মাঝে মতবিরোধ তো ছিলই, এখন সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে’- যোগ করেন তিনি। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘আমাদের পার্টিতে কোনো বিরোধ নেই।’

এইউএ/এমএআর/এমএস