গত সপ্তাহে 'স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির ঐক্য!' এই কলামে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সরকার বিরোধী বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ জামায়াত প্রশ্নে হোঁচট খেতে পারে বলে শঙ্কার কথা লিখেছিলাম। একদিন যেতে না যেতেই সে আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য এখন জামায়াত প্রশ্নে হাবুডুবু খাচ্ছে।
Advertisement
জামায়াতের সাথে ঐক্য থাকবে না, এই মৌখিক আশ্বাস দিয়েই বিএনপি প্রতিনিধিদল জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি কথা রাখেনি। তারা ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গেও আছে, জামায়াতের সঙ্গেও আছে। তবে এই দুই নৌকায় পা দিয়ে বিএনপি নির্বাচনের উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে পারবে কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন।
বিএনপি যে কৌশলে দুই নৌকা সামাল দিতে চাচ্ছে, সেটা অবশ্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই শেখা। আওয়ামী লীগ যখন জাতীয় পার্টির সাথে জোট করতে চাচ্ছিল, তখন তাদের মূল জোট ১৪ দলের শরিক জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অনেকেই স্বৈরাচারের সাথে জোট করতে আপত্তি জানায়। তাদের আপত্তি আমলে নিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ১৪ দলে না নিয়ে তাদের সাথে মহাজোট করে। সেই থেকে মহাজোট আছে।
জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে থাকলেও ১৪ দলে নেই। জোটে জাতীয় পার্টির সাথে বসতে আপত্তি করলেও জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা মন্ত্রিসভায় তাদের বসছেন ঠিকই। সেই কৌশলে বিএনপি ২০ দলীয় জোটে জামায়াতের সাথে থাকলেও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় গেছে আলাদাভাবে। কিন্তু বিএনপির এই কৌশল মানতে রাজি নন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা। ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, জামায়াতকে ছেড়ে না এলে জাতীয় ঐক্যে বিএনপিকে স্বাগত জানানো হবে না।
Advertisement
দুদিন পর বি চৌধুরীর বাসায় অনুষ্ঠিত ঐক্য প্রক্রিয়ায় বৈঠকে জামায়াতের ব্যাপারে তাদের অবস্থান আরো স্পষ্ট করা হয়। বৈঠক শেষে বি চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, 'কথা পরিষ্কার, আমাদের বৃহত্তর ঐক্যে স্বাধীনতাবিরোধী কেউ থাকতে পারবে না। কেবলমাত্র স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষের সবাইকে নিয়ে এই ঐক্য হবে।'
বৈঠক থেকে লিখিত প্রস্তাবনা তুলে দেয়া হয় বিএনপির প্রতিনিধি ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর হাতে, যাতে জামায়াত ছাড়ার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। পরে অন্য এক অনুষ্ঠানে বিকল্পধারার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী বলেছেন, 'আপনি এক হাতে জামায়াতকে ধরবেন, এক হাতে আমাদের। জামায়াতের সাথে সংসার করবেন, আমাদের সাথে পরকিয়া; এটা চলবে না।'
কিন্তু বিএনপি যে জামায়াতকে ছাড়বে না বা ছাড়তে পারবে না, তা মোটামুটি পরিষ্কার। বি চৌধুরীর বাসার বৈঠকের দুদিন পর গুলশানে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক হয়। বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল হালিম। তিনি জানান, সরকার পতনে বৃহত্তর ঐক্যের বিকল্প নেই। বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থেই তাদের নিয়ে বিভিন্ন মহলে যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে তা নিয়ে তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। বৈঠকে বিএনপির এক নেতা এই সহিষ্ণুতার জন্য জামায়াতকে ধন্যবাদও জানান।
জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার অনড় অবস্থানকে বরং বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা সন্দেহের চোখে দেখছেন। তারা মনে করছেন, ভোটের অঙ্কে জামায়াতই বিএনপির আসল সহায়। সংখ্যায় অল্প হলেও সারাদেশেই জামায়াতের নির্দিষ্ট কিছু ভোট আছে, যা জয়-পরাজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জামায়াত ম্যাজিকে ভর করেই ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। বিনিময়ে দুই যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বিএনপি-জামায়াতের ভোট ম্যাজিকের কাউন্টার দিতে আওয়ামী লীগ দ্রুত কাছে টানে জাতীয় পার্টিকে।
Advertisement
রাজাকারের কাউন্টার স্বৈরাচার। জামায়াতের মত অত সংগঠিত না হলেও জাতীয় পার্টিরও সারাদেশে নির্দিষ্ট কিছু ভোট আছে। ভোটের সহজ অঙ্কটা হলো- যদি বিএনপি-জামায়াতের কাঠালের আঠা ধরনের প্রেমে ভাঙন ধরানো যায় আর জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের পাশে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ অনেক নির্ভার থাকতে পারবে।
বিএনপি-জামায়াত জোটে ভাঙন ধরানোর অনেক চেষ্টা আওয়ামী লীগ করেছে, করছে; তবে এখনও সফল হতে পারেনি। সেই একই চেষ্টা এখন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এ কারণেই বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা ঐক্য প্রক্রিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তাদের শঙ্কা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া বিএনপি জামায়াতের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারলে তার সুবিধা পাবে আওয়ামী লীগ। তাদের ধারণা যুদ্ধাপরাধের দায় নিয়ে শীর্ষ নেতারা ফাঁসিতে ঝুললেও জামায়াতের ভোট ব্যাংক অক্ষুণ্ণ আছে, তৈরি আছে তাদের কর্মীরাও। যেহেতু জামায়াতের এখন নিবন্ধন নেই, তাই নেই প্রতীকও।
জামায়াত নিশ্চয়ই নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, বিএনপির পাশে থাকবে। বিএনপিও তার এই অবধারিত সঙ্গীকে হারাতে চায় না। আবার বিএনপি ড. কামাল হোসেনের আন্তর্জাতিক ইমেজকে পুঁজি করে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের হাইপ তুলতে চায়।
বিএনপির এই দ্বৈত ভূমিকার উদাহরণ ৩০ সেপ্টেম্বরের জনসভা। অনেকদিন পর তারা একা জনসভা করলো। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ ২০ দলীয় জোট হিসেবে করলে আর ২০ জন নেতাই শুধু যোগ হতো। একক জনসভার মাধ্যমে বিএনপি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের বোঝাতে চাইলো, দেখুন জামায়াত আমাদের সাথে নেই। কিন্তু তলে তলে যে আছে, সেটা তো ২০ দলীয় জোটের রৈঠকে জামায়াতকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। একক জনসভায় বিএনপি নেতাদের কেউই জামায়াদের নামও উচ্চারণ করেননি।
খালি গয়েশ্বর রায় বলেছেন, 'শয়তানও যদি আমাদের সাথে জোট বাঁধে, সরকার হটানোর প্রশ্নে আমরা তাকেও বন্ধু ভাববো।' তার মানে ক্ষমতায় যাওয়াটাই গয়েশ্বর বাবুর কাছে মূল কথা; কে শয়তান, কে সাধু; তা বিবেচ্য নয়। নেতারা কেউ না বললেও সাধারণ নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, তারা ভোটবিহীন ঐক্যের চেয়ে, ফিক্সড ভোটের জোটেই বেশি আগ্রহী।
তবে বিএনপির এই ভোটের অঙ্কে বড় একটা গলদ আছে। অল্পকিছু ভোটের নগদ লাভের আশায় জামায়াতের সাথে জোট বেঁধে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের দলটি এখন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। দোদুল্যমান অনেকেই বাধ্য হয়ে আওয়ামী শিবিরে ভিড়ছেন।
গত সপ্তাহের লেখাটি শেষ করেছিলাম আমার অনেকদিনের একটা স্বপ্ন দিয়ে- বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল হবে স্বাধীনতার পক্ষে। তাদের মধ্য থেকে জনগণ বেছে নেবে পছন্দের দল। দুদিন আগে ফেসবুকে একজন লিখলেন এই স্বপ্নের উল্টো ভার্সন- তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট নয়, বরং চান জামায়াত আলাদা নির্বাচন করুক।
তার ধারণা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হওয়ার মত আসনও পাবে না। সে ক্ষেত্রে বিএনপি সরকারের বিরোধী দলের দায়িত্ব নিতে হবে জামায়াতকে। অবশ্য এটাও আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই শেখা, যেভাবে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল।
তবে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য-অনৈক্য নিয়ে যে ধোঁয়াশা, তা কেটে যাবে শিগগিরই। বিএনপি বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার সময় পাবে না।
১ অক্টোবর, ২০১৮
এইচআর/জেআইএম