মতামত

ব্রেক্সিট এখন ব্রিটেনের রাজনীতির উত্তপ্ত ইস্যু

ব্রিটেনের রাজনীতিতে একটা প্রচলিত সত্য সংস্কৃতি হলো যে, জনগণ নির্বাচনমুখী নয়। অর্থাৎ ব্যাপক মানুষ ভোট দিতে আসে না। ভোটের সময় ভোটারের উপস্থিতি থাকে অপ্রতুল। ৪০ শতাংশেরও নিচে থাকে ভোটারদের উপস্থিতি। কিন্তু তবুও গণতন্ত্র ঠিক মতই কাজ করে।

Advertisement

কমসংখ্যক মানুষের ম্যান্ডেটকেই ব্রিটেনের মানুষ তাদের ম্যান্ডেট হিসেবে ধরে নেয়। রাষ্ট্র চালিত হয়, সরকার আর বিরোধী দলের আলোচনা কিংবা সরগরম বাকবিতন্ডার মধ্য দিয়েই। বিরোধী দলের আলোচনা, গণমাধ্যমের মত-দ্বিমত অর্থাৎ ব্রিটেনের মানুষের স্পন্দন অনুভব করেই অনেক সময়ই সরকার মনোভাব বদলায়। সে হিসেবেই জনমানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সরকার নিয়েই থাকে।

এমনি একটা সিদ্ধান্ত ছিল ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট। ব্রিটেনের ইতিহাসে এ নির্বাচন ছিল এক যুগান্তকারী ভোট। কারণ এর আগে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচনেও এত অধিক সংখ্যক ভোট প্রদান করেনি ব্রিটেনের মানুষ। মোট ভোটারের ৭২ শতাংশ এতে ভোট প্রদান করে তখন। খুবই স্বাভাবিক এক অনুধাবন যে, ব্রিটেনের মানুষ মনে করেছিল এটা তাদের অস্থিত্বের প্রয়োজনে হয়ত জরুরি।

গত কয়েক বছর থেকে ব্রিটেনে অধিক সংখ্যক অভিবাসী বিশেষত ইউরোপীয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে অভিবাসী আগমন ব্রিটেনেকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে মনে করে দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী। হয়ত সেকারণেই লন্ডন বার্মিংহাম ম্যানচেস্টার থেকে শুরু করে বড় বড় শহরগুলোতে ব্রেক্সিট-রিমেইনের পক্ষে অধিক সংখ্যক ভোট পড়লেও অন্যান্য জায়গায় লীভ বা বেরিয়ে আসার পক্ষে ভোট পড়েছে বেশি। স্বীকার করতেই হবে এটাই জনগণের পালস বা হৃদকম্পন। একটা দেশ শুধু রাজধানী কিংবা বড় বড় শহর নির্ভর নয়, একটা দেশের ভিত মজবুত করে সেই দেশের গোটা জনশক্তি। এই জনশক্তি ভোটের মাধ্যমেই তাই তাদের শক্তির জানান দিয়েছিল ।

Advertisement

কনজারভেটিব দলের দ্বারা পরিচালিত সরকারের সাবেক লিডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের নেতৃত্বে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালে। লেবার কিংবা কনজারভেটিভ দলের নেতৃত্বের অধিকাংশই ব্রেক্সিটের রিমেইনের পক্ষে থাকলেও ব্রিটেনের জনতা ব্রেক্সিটের পক্ষেই অর্থাৎ ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে তাদের ভোট প্রদান করেছিল। ব্রেক্সিটের বিপক্ষে দলের হয়ে ক্যামেরুন তার প্রচারণা চালালেও শেষ পর্যন্ত তার প্রচারণাও কলকে পায়নি। তাই ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন, দেশটির হাল ধরেছিলেন তার দলেরই তেরেসা মে। গণভোটের পর থেকেই তাই ব্রিটেন ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

কিন্তু ২৯ মার্চ ২০১৯ খুব দূরে নয়। ঐদিন স্থানীয় সময় রাত ১১টায় চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হবে ব্রিটেনের। ইউরোপীয়ান ইউনিয়েনের সাথে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের ক্ষণ যতই সময় ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে দেমটির অভ্যন্তরে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সাথে বিভিন্ন চুক্তি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তেরেসা মে’র সরকার। ‘হার্ড আর সফট’ ব্রেক্সিট নিয়ে কথা উঠেছিল আগেই। তেরেসা মে রাজনীতিবিদদের এ কথার জবাব দিয়েছিলেন, বলেছিলেন হার্ড-সফট নেই,‘ব্রেক্সিট ইজ ব্রেক্সিট’।

কিন্তু তার দল থেকে শুরু করে বিরোধী শিবিরেও নেতাদের একটা বিরাট অংশ ব্রেক্সিট রিমেইনের পক্ষে এমনকি লেবার দলের নেতা জেরেমী করবিনের মনোভাবনকে এতদিন লেবার দলের একটা বড় অংশই মনে করত, তিনিও ব্রিটেন বিচ্ছেদের লোক। কিন্তু দলের একটা বড় অংশের চাপ সামলাতে না পেরে পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েই লেবার পার্টির ২৩ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বরের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি আবারও ব্রেক্সিট রিমেইনের পক্ষেই কথা বললেন।

এদিকে অনেক নেতাই ইতিমধ্যে দাবি করছেন, ব্রেক্সিট নিয়ে আবারও দেশটাতে গনভোটের দাবি তোলছেন সরকারি দল এবং বিরোধী দলের অনেক জনপ্রতিনিধি। তাদের ভাষায় ব্রিটেনের মানুষ হয়ত তাদের মতামত বদলাতে পারে, তাই। সত্যি কথা বলতে কি, এটা এক হাস্যকর ব্যাপার। কারণ একবার মানুষ ভোট দিয়েছে। গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দিয়েছে। এখন নেতাদের বাদানুবাদে দেশটার মানুষ আবার বলি হতে যাবে কেন। এমনতো কোন গ্যারান্টিও নেই যে, মানুষ ব্রেক্সিট রিমেইনের পক্ষে ভোট দিয়ে দেবে।

Advertisement

তাছাড়া মানুষ যেখানে ভোট দিয়ে দিছে, সেকারণে আবার ভোটের আয়োজন করা বলতে গেলে জনগণের রায়ের প্রতি এক ধরনের অসম্মান করারই সমান। আর যদি ভোট অনুষ্ঠিত হয়েই যায় (যদিও সম্ভাবনা নেই) এবং ফলাফল আগের মতই হয়, তাহলে জনগণের ট্যাক্সের মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতেই যাবে কেন সরকার। এবং ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে তার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেই দিয়েছেন, তিনি এ নিয়ে নতুন করে গণভোটের আয়োজন করবেন না।

ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ এই বাদানুবাদে এবং নেতাদের অনৈক্যে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের নেতারা আছেন খোশমেজাজে। তার খেলতে চাইছেন ব্রিটেনকে নিয়ে। আর সেকারণে একটা বড় ধরনের চাপের মাঝে আছে তেরেসা মে’র সরকার। স্মরণকালের এক বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটে দিন পার করছে এখন ব্রিটেন। যুক্তরাজ্য যে প্রস্তাব করেছিল, ইতিমধ্যে ইইউ তা নাকচ করে দিয়েছে। এমনকি যে সমঝোতার জন্যে তেরেসা মে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তা-ও যেন হোঁচট খেল গত ২০ সেপ্টেম্বর।

ইইউ’র প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাস্ক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যুক্তরাজ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে কমন রুল নীতির কথা বলেছে, তা তাদের কাছে অকার্যকর। এমনকি এ নিয়ে তিনি ব্যক্তিগত যোগাযোগ মাধ্যমে হাস্যরস করেছেন। তিনি একটা কেক কাটার ছবি দিয়ে বলেছেন, ‘এখানে শুধুই কেক, কোন চেরী নেই’। ইইউ ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই মনে করছে, যুক্তরাজ্য ‘চেরী পিকিং’ করছে অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সবকিছুই করতে চাইছে তারা।

আর সেজন্যে তেরেসা মে জাতির উদ্দ্যেশ্যে দেয়া এক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, যুক্তরাজ্যের স্বার্থবিরোধী কোন সমঝোতায় তিনি যাবেন না, ব্রিটেনের সাথে সম্মানজনক আচরন করতে তিনি ইউরোপীয়ান ইউনিয়েনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন । আর তা না হলে প্রয়োজনে কোন চুক্তি ছাড়াই তিনি ব্রেক্সিট বা ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘঠাবেন বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি এখন ব্রেক্সিট বা বিচ্ছেদ না করেও উপায় নেই।

তেরেসা মে’র ব্রেক্সিট সমর্থনকারী অনেক এমপি’র একজন টোরী এমপি ক্রেইগ ম্যককেইনলি সম্প্রতি জোর দিয়ে বলেছেন, গত গণভোটে ১৭.৪ মিলিয়ন মানুষ ভোট দিয়েছে দেশটার স্বাভাবিক স্বাধীনতার ব্যাপারে। তারা চায়না দেশটার আইন প্রণয়নে কেউ নাক গলাক, এই মানুষগুলো চায় না তাদের দেশের আইন- অর্থের উপর অন্য কেউ খবরদারি করুক। জন প্রতিনিধিদের অনেকেই ব্রেক্সিট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও সাধারণ জনসাধারণ এতে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।

সারাজীবন লেবার পার্টির সমর্থক একজন শ্বেতাঙ্গ পেনশনার (অবসর নেয়া নির্মাণ শ্রমিক)‘ সেদিন আলাপকালে জানালেন, ১৯৭৫’র আগেও যেমন অর্থাৎ ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হবার পরবর্তীতেও আমাদের এই ব্রিটেনের জনজীবনে খুব একটা পার্থক্য আমি দেখি না । আমি আশাবাদী বেক্সিট হলে বড় ধরনের কোন আঘাত আমাদের সইতে হবে না’।

ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোটে বিশাল অংশের মানুষের সমর্থনের পেছনে অনেক কারণ ছিল। বলতে গেলে ব্রিটেনের মানুষ অভিবাসন নিয়ে হতাশ। অভিবাসন ব্রিটেনের একটা প্রধান ইস্যু। ইউরোপ থেকে ব্রিটেনে যেন মানুষর ঢল নেমেছে গত কয়েক বছর। ইইউ’র নিয়মানুযায়ী ইউরোপের এই জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানসহ মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকা নিশ্চিত করাটা ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্ব। আর তা করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্কুলগুলোতে আসন সংকট বেড়েছে।

এমনিতেই ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস তাদের সেবাদানে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবোধক। এর উপর অভিবাসীরা এসে হাসপাতালগুলোওে সৃষ্টি করছে সংকট। যেগুলো চোখে পড়েছিলো ব্রিটিশ জনগণের। ব্রিটিশ জনগণ তাই ইমিগ্রেশনের একটা সীমারেখা টানতে চাইছিলো। সে সীমারেখা এবার টানবেন তেরেসা মে। দেশের জনগণই তাকে এই ম্যান্ডেট দিয়েছে।

২০০৮ সালের মন্দা কাটিয়ে উঠেছে ব্রিটেন। বাড়িঘরের মূল্য কমে নাই বরং বৃদ্ধি পেয়েছো কিন্তু ব্রেক্সিট বিরোধীরা বলছেন, কোন সুষ্ঠু চুক্তি ছাড়া ব্রিটেন বেরিয়ে এলে জনজীবনে এর বড় প্রতিক্রিয়া পড়বে। অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগতে পারে, দ্রব্যমূল্য আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে। বাড়ি-ঘরের দাম কমে যেতে পারে।

তবে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সাথে যদি আশাব্যঞ্জক ব্যবসায়িক চুক্তি চুক্তি না-ও হয়, তবে তেরেসা মে’র সরকার যে অন্য বাজার খুঁজবে না তাতো অবশ্যই নয়, সম্পর্ক উন্নয়নের ভিন্ন রাস্তা ইতিমধ্যে তারা খুঁজতে শুরু করেছে। আপাত ধাক্কা খেলেও তেরেসা মে তা সামলে উঠতে পারবেন বলেই মনে করছে সাধারণমানুষ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম