মতামত

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সমাচার

অবহেলা অপরাধ। এদেশের হাসপাতাল তা বার বার প্রমাণ করেছে। এসবই পরিচিত গল্প। কিন্তু সবটুকু নয়। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে কয়েকদিন ধরে আছি রাজধানীর বুকে দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালগুলোর একটিতে। রোগীর ভিড়ে রীতিমত বিপাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল। সবখানেই রোগী। বারান্দায়, মেঝেতে, এমনকী হাসপাতালের বাইরেও শুয়ে থাকতে দেখছি রোগীদের। স্ট্যান্ড নেই, স্যালাইন ধরে রয়েছেন আত্মীয়েরা, এমন দৃশ্যও আছে।

Advertisement

ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক অনেক বেশি রোগী নিয়ে যখন একটি হাসপাতাল হিমশিম খায়, তখন ব্যবস্থাপনা বলে আর কিছু আসলে থাকেনা। যারা আসে তারা বেশিরভাগই আসে দূর দূরান্ত থেকে, নিতান্ত সব দরিদ্র মানুষ। একজনের সাথে কতজন যে আসে সেটা রোগীর পরিবারের লোকজনও জানে না। এমন রোগীও পেয়েছি, যার সাথের লোকজন এলাকার নামটিও ঠিকমত বলতে পারে না। দুই একটি কেবিনে মধ্যবিত্ত কয়েকজন আছেন মাত্র।

এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আমার গৃহ-সহকারী রোজিনাও ছিল ঢাকার সরকারি পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানেও একই অবস্থা দেখেছি। রোজিনাকে বাঁচানো যায়নি। ডাক্তার আর হাসতপাতাল সহকারীদের হিমশিম অবস্থা সেখনেও দেখেছি। একেকটা জরুরি রোগী আসে, তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার সময় থাকছে না চিকিৎসক ও তাদের স্টাফদের।

রোগী আসে, রোগী যায়। কেউ বাঁচে, কেউ না বেঁচে ফেরে। কিন্তু চিকিৎসা কি হয় হওয়ার মত করে? চিকিৎসা মানেতো স্যালাইন আর অক্সিজেন নয়, রোগীর প্রতি নিয়মিত নজর রাখা। আর তার জন্য দরকার চিকিৎসার প্রতি রোগীর আস্থা আর সাহস। কিন্তু তা কি করে সম্ভব এমন পরিস্থিতিতে?

Advertisement

আমাদের দেশ এত উন্নয়ন করছে, স্বাস্থ্য সেবায়ও অবকঠামোগত কোন সীমাবদ্ধতা নেই। সরকারি হাসপাতাল সত্যিকার অর্থে হাসপাতালই হতে পারেনি। রোগীর ভিড়ে কেবলই বিশৃঙ্খলা। এখানে যা যা চিকিৎসা করা হয় তা যেমন করা উচিত তেমনই করা হয়। হাসপাতালসমূহে রোগীর সংখ্যা সত্যিই খুব বেশি। তুলনায় ডাক্তার কম, বিশেষ করে নার্সিং স্টাফ বেশ কম। আর এ কারণেই চিকিৎসা ব্যবস্থা আজ বিপন্ন।

আমরা বলি রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যেকার বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। কিন্তু কেন ধরেছে তা হয়তো আমরা কখনোই গভিরে কি ভাবিনি। ডাক্তার যেটা করেন সেটা রোগীর ভালর জন্য করেন, এবং রোগী ডাক্তারের সিদ্ধান্ত ও চিকিৎসা বিনা প্রশ্নে মেনে নেবেন। বহু শতক ধরে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে রোগী ও চিকিৎসকের সম্পর্ক এই পথেই চলেছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কতটুকুইবা আস্থার ভিত্তি রচনা করা যায়, সে এক প্রশ্ন।

চিকিৎসা মানে এক ধরনের শেয়ারড ডিসিশন-মেকিং। ডাক্তার রোগী ও তার পরিবারকে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে অবহিত করবেন, রোগীও তার আর্থিক সামর্থ্য, রোগের ইতিহাস, পছন্দ ইত্যাদি বিষয়ে ডাক্তারকে জানাবেন। উভয় পক্ষের মত ও প্রয়োজনের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে যৌথ ভাবে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশব্যাপী সরকারি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের সাথে এই শেয়ারিং সম্ভব হয় না। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাই তারা এখানে আসেন। রোগের ইতিহাস বলার মতো যোগ্যতা নেই বেশিরভাগের।

আমাদের প্রত্যাশা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ দেখাবেন। সন্দেহ নেই অনেক ক্ষেত্রেই তার অভাব আছে। সরকারি হাসপাতালে রোগীর ভিড়, আর তাই নানা কিছুর অভাব। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মুনাফার লোভ। এমন এক অবস্থায় আমাদের দেশে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে সত্যিকারের কোন যোগাযোগই গড়ে উঠলোনা।

Advertisement

একজন ছাত্র বা ছাত্রী যখন চিকিৎসাবিদ্যার মহাবিদ্যালয়ে পড়তে যান, তখন অনেক স্বপ্ন থাকে মনে। পাঠ্যক্রমের তারা চিকিৎসা-সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞান আহরণ করেন, সেই জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে শেখেন এবং মনোযোগের সাথে মূল্যবোধের প্রয়োগ করার বিদ্যা রপ্ত করেন। আমাদের সাধারণ ধারণা বাংলাদেশে চিকিৎসাবিদ্যায় সবচেয়ে অবহেলিত হলো মূল্যবোধ। তবে আমরা জানিনা কোন কোন খাতেই বা মূল্যবোধের প্রাবল্য আছে।

রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা, রোগের উপসর্গ, বিস্তার, এই সব পর্যবেক্ষণ করেন চিকিৎসক, সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দেন। তার সঙ্গে খেয়াল রাখেন রোগীর শরীরী ভাষা, বাচনভঙ্গি, পোশাকআশাক, আবেগ অনুভূতি। রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ মিলিয়ে রোগী সম্পর্কে চিকিৎসকের সম্যক ধারণা তৈরি হয়, যার প্রতিফলন ঘটে চিকিৎসায় এবং রোগীর প্রতি তার আচরণে। এই ধারণা এবং তার প্রতিফলনের মিল থাকলে চিকিৎসা ঠিক পথে এগোয়, রোগী ও চিকিৎসকের সুসম্পর্কও বজায় থাকে।

এই সুসম্পর্ক কেন গড়ে উঠেনা, তা নিয়ে চিকিৎসকরা ভাববেন আশা করি। কিন্তু বেশি ভাবতে হবে রাষ্ট্রকে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংকট আছে, কিন্তু এর উন্নতি করার সাধ্য যে আমাদের আছে সেই বিশ্বাসটুকু আগে জাগ্রত করতে হবে। ঢাকায় কিছু চিকিৎসা থাকলেও বাইরের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের অভাব, সরঞ্জামের অভাব প্রকট। সব কিছু ঠিক চলছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করার কেউ নেই, নেই উপায়ও।

হাসপাতাল চত্বর পরিষ্কার করা একটা দরকারি কাজ। সেটি হয়না বললেই চলে। আমরা প্রায়ই দেখি রোগীর মৃত্যু বা চিকিৎসা ত্রুটির অভিযোগ নিয়ে হাঙ্গামা। নীতি নির্ধারকদের ভাবা দরকার অবকাঠামোর পাশাপাশি কি করে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থার উপরে আস্থা তৈরি করা যায়।

অন্যদিকে ডাক্তারের বদলে ওয়ার্ডবয় দিয়ে চিকিৎসা, ভুল বা নকল প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট, ওধুধ কোম্পানি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে ডাক্তারদের কমিশন সিস্টেম যে আমাদের চিকিৎসার স্বরূপ নয় তা প্রমাণ করা দায়িত্ব স্বাস্থ্যখাতের লোকজনেরই। কতিপয় প্রতারককে শাস্তি দিয়ে এই উদ্বেগ প্রশমিত হবেনা। মেডিক্যাল কাউন্সিল, স্বাস্থ্য মন্তণালয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কর্তব্যে কেন ব্যর্থ, তার অনুসন্ধান প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে না দেখলে আস্থার পরিধি সংকুচিত হবেই। তাতে অসহিষ্ণুতা এবং হিংসা বাড়ে, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হয় না।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস