খেলাধুলা

স্বপ্নিল সূচনার কি অস্বাভাবিক সমাপ্তি!

পুরো আসরে ওপেনাররা চরম ব্যর্থ। তার ওপর এক নম্বর ওপেনার তামিম ইকবাল প্রথম দিন শ্রীলঙ্কার সাথে হাতের কব্জিতে বলের আঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে। লিটন দাসের সাথে নাজমুল হোসেন শান্ত আর সৌম্য সরকারকে দিয়ে ট্রাই করানো হয়েছে। দুজনই ব্যর্থতার ঘানি টেনেছেন।

Advertisement

আগের পাঁচ ম্যাচে উদ্বোধনী জুটির সর্বোচ্চ সংগ্রহ ছিল ১৬। তাই বাধ্য হয়ে উদ্বোধনী জুটিতে পরবির্তনের চিন্তা। অধিনায়ক মাশরাফি আগের দিনই বলেছিলেন, কখনো ওপেন করেনি এমন কেউ লিটন দাসের সঙ্গী হবে। যে কথা সেই কাজ। লিটন দাসের সাথে ব্যাট হাতে নতুন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের দেখা মিললো।

একদম গাণিতিক ও পরিপাটি ব্যাটিং না করলেও ব্যাটিংটা মোটামুটি জানা মিরাজের। তবে সৌম্য, লিটনের মত ফ্রি স্ট্রোক খেলার সামর্থ্য কম। বিগ হিট নিতে কম পারেন বলে হাত খুলে খেলার চেয়ে ব্যাকরণ মেনে বলের মেধা গুণ বিচারে ব্যাট চালানোর চেষ্টাই থাকে। আজও তাই করলেন। কোন বাড়তি ঝুঁকি নিলেন না। উচ্চভিলাষি শট খেলার চেয়ে যতটা সম্ভব বেশি সময় উইকেটে থাকার চেষ্টাই করলেন। আর অপেক্ষায় থাকলেন আলগা বলের। এভাবে খেলে খুব যে বেশি দূর গেলেন, তা নয়। তার ব্যাট থেকে আসলো ৩২ রানের এক মাঝারি ইনিংস।

এ ইনিংস নিয়ে কোনো মহাকাব্য রচিত হবে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ইনিংসের সূচনা করতে নামা অনেক ব্যাটসম্যানের গন্ডায় গন্ডায় শতরান আছে। কিন্তু তারপরও মিরাজের এ ইনিংসটি ব্যতিক্রম।

Advertisement

ওপেনারদের রান খরায় যেন ‘মরুর মাঝে ঝড়না।’ আসল কথা হলো, মিরাজকে যে দায়িত্ব দিয়ে আট নম্বর থেকে ওপেন করতে পাঠানো হয়েছিল, এ ২০ বছরের তরুণ তা করে দেখালেন। বেশ খানিকটা সময় একদিক আগলে রাখলেন।

অপর প্রান্তে লিটন দাস খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। অতি বড় লিটন বিরোধি আর অন্ধ তামিম ভক্তও মানছেন, একজন ওপেনার হিসেবে যত ভালো খেলা সম্ভব, এশিয়া কাপের আজকের ফাইনালে তত ভালোই খেলেছেন লিটন।

ভুবনেশ্বর কুমার, জাসপ্রিত বুমরাহ, চাহাল, কেদর যাদব ও অন্যান্য ভারতীয় বোলারদের বিপক্ষে তামিম, মুশফিক ছাড়া আর কোন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক সময়ে এত স্বচ্ছন্দে খেলেছেন কিনা, সন্দেহ।

একদম অনায়াস ও সাবলীল ব্যাটিং। যে শট যেখানে খেলতে চেয়েছেন, সেখানেই খেলতে পেরেছেন। ইনিংসের ১২ নম্বর ওভারে বাঁহাতি স্পিনার রবীন্দ্র জাদেজার বলে স্লগ সুইগ করতে গিয়ে চাহালের হাতে জীবন পাওয়া (৫২ রানে) ছাড়া পুরো ইনিংসে কোন ভুল শট খেলেননি লিটন। দেখে মনে হলো অনেক বড় মাপের ওপেনারের প্রতিমূর্তি। তাই তো লিটন আর মিরাজের অসামান্য রসায়নে প্রথম উইকেটে উঠলো ১২০ রান। তাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিংবা সম্বুক গতিতে নয়। প্রায় বল পিছু (২০.৫ ওভারে)।

Advertisement

যে দলটির সাড়াশি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বোলিং শক্তি এখন বিশ্ব সেরা, যাদের পেস ও স্পিন আক্রমণ সামলাতে অনেক বড় দলের নাভিশ্বাস ওঠে, এ আসরেও কেউ একবারের জন্য মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, সেই ভারতীয় বোলিংয়ের বুক চিরে এত বড় উদ্বোধনী জুটি যে অনেক বড় স্কোরের ভিত। ভাবা হচ্ছিলো সেই শক্ত মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে পরের প্রায় ৩০ ওভারে আরও অনেকদূর যাবে বাংলাদেশ। মানে রান ৩০০ স্পর্শ করবে।

এমন ভেবে ভক্ত ও সমর্থকরা যখন বড় কিছুর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই শুরু হলো বিপর্যয়। একদম ভোজভাজির মত পাল্টে গেল দৃশ্যপট। এত ভালো অবস্থা থেকে যতটা খারাপ হতে পারে, তাই হলো।

ওপেনার হিসেবে সামর্থ্যের বেশি ভালো খেলার পর মিরাজ যেই উচ্চাভিলাষি শট খেলতে গেলেন, ঠিক তখনই আউট হলেন। হঠাৎ তার মনে হলো, আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে রান গতি বাড়াই। আর সেটাই হলো কাল। অফব্রেক বোলার কেদর যাদবকে অন সাইডে সরে কভার ও পয়েন্টের মাথার ওপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে কভার পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন মিরাজ।

উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গার পরই বদলে গেল দৃশ্যপট। ভারতীয় স্পিনাররা দুদিক থেকে চেপে ধরলেন। চাহাল, কুলদীপ যাদব, রবীন্দ্র জাদেজা , কেদর যাদবরা একদম মাথা ঠান্ডা রেখে ভালো জায়গায় ক্রমাগত বল করলেন। এতটুকু জায়গা দিলেন না। শর্ট বল নেই। একদম উইকেট সোজা থ্রি-কোয়ার্টার লেন্থের সে সব ডেলিভালির বিপক্ষে ঠান্ডা মাথায় সিঙ্গেলসে খেললেই চলতো। কিন্তু তা না করে বাংলাদেশের মিডল অর্ডাররা প্রায় সবাই বিগ হিট নিতে গেলেন।

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ভুলেই গেলেন, খেলাটা ৫০ ওভারের। প্রথম ২০ ওভারে ওভার পিছু প্রায় ছয় রান করে উঠেছে। ২০ থেকে ৩০ এমনকি ৩৫ ওভার পর্যন্ত রান তোলার গতি কমে চার থেকে পাঁচে থাকলেও সমস্যা নেই। মাঝের সময়টা বিগ হিটে যাবার চেয়ে হাতে উইকেট রেখে খেলাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। হাতে পর্যাপ্ত উইকেট রেখে ৩৫ কিংবা ৪০ ওভার পর্যন্ত খেলতে পারলে, শেষ ১০ ওভারে আবার চড়াও হওয়া যাবে। তখন ওভার পিছু সাত থেকে আট রান করে তোলাও অসম্ভব না। আর তা করতে পারলে ২৮০ ‘র ওপরে রান উঠতো।

কিন্তু হায়! এ কঠিন সত্য উপলব্ধিতে ভুল হলো সবার। সিঙ্গেলস-ডাবলসে খেলে রান চাকা সচল রাখার বদলে সবাই তেড়েফুড়ে মারতে গেলেন। ইমরুল শুধু ডিফেন্স করতে গিয়ে আউট। দুই সেরা ও পরিণত ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আবারো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভুল পথে পা বাড়ালেন।

সংকটে হাল ধরা এ দুই পরিণত পারফরমার ভারতীয় স্পিনারদের মাপা ও বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে মাথা ঠান্ডা রেখে আগানোর বদলে একটু বেশি তড়িঘড়ি করে বিগ হিট খেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেন। যা ‘বুমেরাং’ হলো। যখন উইকেট হাতে রেখে সিঙ্গেলস-ডাবলসে খেলে সামনে আগানোর সময়, তখন শুধু বলগাহীন উইলোবাজিই হলো না, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটও খারাপ হলো। অনাবশ্যক রান নিতে গিয়ে রান আউটের শিকার হলেন মিঠুন, সৌম্য আর নাজমুল। সে কারণেই ২০ ওভার পেরিয়ে উদ্বোধনী জুটিতে ১২০ রান ওঠার পর আর একটি জুটিও তৈরি হলো না। উল্টো নিয়মিত বিরতিতে উইকেটের পতন ঘটলো।

ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করা লিটন দাস (১১৭ বলে ১২১), মেহেদী মিরাজ (৩২) আর শুধু সৌম্য সরকার (৩৩) দু'অংকে পা রাখলেন। ইমরুল (২), মুশফিক (৫), মিঠুন (২), মাহমুদউল্লাহ (৪), মাশরাফি ( ৭), নাজমুল অপুু (৭) সবাই ব্যর্থতার মিছিলে অংশ নিলেন।

আগের পাঁচ খেলায় শুরুতেই ব্যাকফুটে চলে গিয়ে মিডল অর্ডারের দৃঢ়তায় আবার খাদের কিনারা থেকে উঠে দাঁড়ানো দল ফাইনালে এসে পেলো দারুণ সূচনা। কিন্তু মিডল অর্ডাররা দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ে স্কোরলাইনকে দীর্ঘ আর মোটা তাজা করা হলো না। যেখানে অনায়াসেই রান ২৬০ পেরিয়ে যাবার কথা, সেখানে মাশরাফির দল থামলো ২২২ রানে। পরিকল্পনাহীন ব্যাটিংয়ে ভেস্তে গেল স্বপ্নিল সূচনা। ১২০ রানে প্রথম উইকেট খোয়ানো দল অলঅাউট ২২২ রানে। মানে ১০২ রানে পতন ১০ উইকেটের। এর চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে?

এআরবি/এমএমআর/পিআর