অর্থনীতি

ব্যাংকের চড়া সুদে পিষ্ট পোলট্রিশিল্প

>> ১২ শতাংশেরও বেশি সুদে গুণতে হচ্ছে ব্যাংক ঋণ>> চড়া সুদে এ খাতে নতুন বিনিয়োগকারী আসছে না >> পুঁজি সংকটে বন্ধের পথে অনেক পোলট্রি খামার>> ঋণ পরিশোধ না করায় ৫০টি খামার কালো তালিকাভুক্ত

Advertisement

চড়া সুদের যাঁতাকলে পিষ্ট দেশের সম্ভাবনাময় খাত পোলট্রিশিল্প। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এ খাত পুঁজি সংকট আর অব্যাহত লোকসানে মার খাচ্ছে। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে ছোট-বড় কয়েকটি খামার। আশা-জাগানিয়া এ খাতের উদ্যোক্তাদের ৮ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়ার কথা কিন্তু ১২ শতাংশের নিচে মিলছে না ব্যাংক ঋণ। ক্ষেত্রবিশেষে এর চেয়েও বেশি সুদ গুণতে হচ্ছে। ফলে নতুন বিনিয়োগ তো আসছেই না, বর্তমান বিনিয়োগকারীরাও পুঁজি সংকটে বন্ধ করে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গার্মেন্টশিল্পের পর দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে পোলট্রি খাত। বিশেষ করে আত্মনির্ভরশীল হতে এ খাতের গুরুত্ব অধিক। প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। যার ৪০ শতাংশই নারী। বর্তমানে দেশে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার পোলট্রি খামার আছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ২.৫ শতাংশ। এর মধ্যে পোলট্রিশিল্পের অবদান প্রায় ১.৫ থেকে ১.৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সূত্র জানায়, দেশে ডিম ও মাংসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২১ সাল নাগাদ এই চাহিদা পূরণে নতুন করে আরও ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু উচ্চ সুদের কারণে এ শিল্প বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে।

Advertisement

বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলেও আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের ধারাবাহিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রয়াস, পোলট্রি খাতের মাধ্যমে সেটি সম্ভব। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চড়া সুদের কারণে সেই সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ছে। এ খাতে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও তা মানছেন না কেউ। সুদ গুণতে হচ্ছে ১২ শতাংশের বেশি। ফলে পোলট্রিশিল্পে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে।

পোলট্রিশিল্পে উচ্চ সুদে ঋণপ্রাপ্তির বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনা হয় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। বৈঠকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। চড়া সুদের কারণে দেশের অনেক পোলট্রি খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্যাংকগুলো একটু ছাড় দিলে খাতটি গার্মেন্টশিল্পের মতো বৃহৎ খাতে পরিণত হতে পারত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ শিল্পে কম সুদে ঋণের সুবিধা দিতে সব ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়া আছে। নিয়ম অনুযায়ী, এ খাতে বিনিয়োগকারীরা সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ পাবেন।’

জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির প্রথম সভায় পোলট্রি খাতে সুদের হার কমানোর প্রস্তাব করা হয়। সে সময় এ খাতের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদহার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।

Advertisement

ব্যাংকের চড়া সুদে পোলট্রি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে- বিষয়টি স্বীকার করে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘পোলট্রি খাতে আট শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার কথা। এমন নির্দেশনা ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা মানা হচ্ছে না। ঋণ নিতে হচ্ছে ১২ শতাংশ সুদে। চড়া সুদের কারণে পোলট্রি শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উদ্যোক্তারা নানা সমস্যায় পড়ছেন। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক খামার।’

স্থায়ী কমিটির চতুর্থ বৈঠকে এ খাতে ভর্তুকি বা স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তার সুপারিশ করা হয়। এ বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণেরও আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি। কমিটির ষষ্ঠ বৈঠকে সুদের হার নিয়ে ফের আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পোলট্রি খাতে ঋণের পরিমাণ জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে কী পরিমাণ ঋণ দিয়েছে এবং ওই ঋণের সুদের হার কত- এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়। কিন্তু প্রতিবেদন তৈরি বা এর কোনো অগ্রগতির খবর এখনও পাওয়া যায়নি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অব্যাহত লোকসানে বেকায়দায় পোলট্রি খাত। ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ চাওয়া হয় কিন্তু তারা দেয় না। আবার দিলেও ১২ শতাংশের ওপরে গুনতে হয় সুদ। ফলে সুদ নিয়ে সময় মতো তা পরিশোধও করা সম্ভব হয় না। এ কারণে অর্ধ শতাধিক খামার কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের কোনো ঋণ দেবে না। ফলে তারা বেকায়দায় পড়েছে। পুঁজি না পাওয়ায় যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে খামারগুলো।’

বিপিআইসিসির তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় চার হাজার টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ পিস। এছাড়া দেশে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি ৬৮ লাখ পিস। আগে ডিম ও ব্রয়লার মুরগি বাইরে থেকে আমদানি হত। এখন দেশেই তা উৎপাদন হচ্ছে। হ্যাচিং ডিমও (যে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন হয়) বাইরে থেকে আসত। এ ডিমও এখন দেশে উৎপন্ন হচ্ছে।

সংস্থাটি আরও জানায়, বর্তমানে দেশে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার পোলট্রি খামার রয়েছে। সবচেয়ে বেশি খামার গাজীপুরে। ২০০৭ সালে এখানে প্রায় আট হাজার খামার ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজারে। বন্ধ হওয়ার পথে ছোট-বড় আরও অনেক খামার।

এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজি সংকটসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে বন্ধ হতে বসেছে অনেক খামার। খামারি আবির হোসেন জানান, যা পুঁজি ছিল তাই দিয়ে খামারটি দাঁড় করাই। আস্তে আস্তে বাকিতে মাল এনে খামারের কার্যক্রম শুরু করি। পরে উৎপাদিত ডিম বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করি। নগদ অর্থে পণ্য কিনতে পারলে ব্যয় কম হত। কিন্তু ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। দিলেও ১৪ শতাংশের ওপরে সুদ চায়। চড়া এ সুদে ঋণ নিলে তো ব্যবসায়ীই গুটিয়ে ফেলতে হবে।

বিপিআইসিসির সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘পোলট্রি খাতের বিকাশে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে চড়া সুদের ব্যাংক ঋণ। ব্যাংকগুলো ১২ থেকে ১৪ শতাংশ হারে সুদ চাচ্ছে। এভাবে সুদ দিয়ে তো ব্যবসা করা অসম্ভব। নতুন বিনিয়োগকারীরাও এ খাতে আসতে সাহস পাচ্ছেন না।’

জানতে চাইলে ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ‘অর্থনীতিতে এ শিল্পের ব্যাপক অবদান রয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগে ঋণ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। যে নির্দেশনার কথা বলা হচ্ছে, তা কোনো ব্যাংক মানছে না। এছাড়া ঋণ না পেয়ে ছোট খামারিরা বাকিতে উচ্চ দামে পোলট্রির ফিড ও বাচ্চা কিনছেন। এতে ব্যয় বেশি হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকেই খামার ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘চাকরির চেয়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে মনোযোগী হতে হবে। গ্রামগঞ্জে আত্ম-নির্ভরশীল হতে পোলট্রির খামার একটি ভালো মাধ্যম। সামান্য পুঁজিতে এটি শুরু করা যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করতে না পারলে টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) যে লক্ষ্যমাত্রা, তা অর্জন সম্ভব হবে না।’

এমএ/এমএআর/জেআইএম