জুলাই থেকে অক্টোবর অবধি সময়কে ডেঙ্গুর জন্য ‘পিক টাইম’ বা সর্বোচ্চ বিস্তারের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সে হিসেবে সামনের মাস অবধি ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ফলে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা হচ্ছে সচেতনতা। সচেতন হলে এ রোগের বিস্তার যেমন ঠেকানো সম্ভব একইভাবে এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমানো সম্ভব।
Advertisement
গত বছর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল লক্ষণীয় মাত্রায়।ডেঙ্গুর উপস্থিতি ছিল সে তুলনায় অনেক কম। আর এ বছর চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা খুবই কম। তবে বেড়েছে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার। সেই সাথে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্ক লোকদের জন্য এ রোগ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ১৩৯ জন এ রোগে আক্রান্ত হন। আর ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৪১ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন (সূত্র: ২৪ সেপ্টেম্বর, জাগোনিউজ২৪.কম)। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রায় অর্ধেক রোগী এ মাসেই আক্রান্ত হয়েছেন।
সামনের মাস অবধি এ জ্বরের মৌসুম হওয়ায় এ রোগের বিস্তার আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর ভেতর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ডেঙ্গুর বিস্তার ধারণার চেয়েও বেশি হতে পারে। ফলে জনসচেতনতার বিষয়টি তাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। জনসচেতনতা ছাড়া এ রোগের বিস্তার, আক্রমণ এবং মৃত্যুর হার কমানো অনেকটাই অসম্ভব।
Advertisement
এবারে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ আগের মতো থাকলেও সমস্যা হচ্ছে ২/১ দিনের ভেতরই আচমকা রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রোগী শকে চলে যাচ্ছে। লিভার, কিডনি, হার্ট—মানে মাল্টি অর্গান ফেলইউর হচ্ছে। এর ফলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি হচ্ছে।
তাই এখন জ্বরের সাথে মাথাব্যথা, গা ব্যথা, শরীরে র্যাশ বা ফুসকুড়ি- এসব থাকলে শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারলে ভালো হয়। তাহলে জটিলতা এড়ানো সম্ভবপর হতে পারে। দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হলেও তখন হয়ত আর করার কিছুই থাকছে না।
আমরা হয়ত অনেকেই জানি যে, এডিস মশার কামড়ের ফলেই ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া বিস্তার লাভ করে। সাধারণত স্বচ্ছ আবদ্ধ জলে এরা ডিম পাড়ে। শহরে বিশেষত ঢাকাতে বছরব্যাপী উন্নয়নকাজের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলে। ফলে গর্তের ভেতরে পানি জমে।
আর সে পানিতে ডিম পেড়ে এডিস মশা বিস্তার লাভ করে। আর বাসাবাড়িতে ফ্রিজের পানি, ফুলের টব এসবে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তার হয়। ফলে, আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা। মশার বিস্তার বন্ধ করতে পারলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণও কমবে।
Advertisement
সেই সাথে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। বিশেষ করে বিকেলে, সন্ধ্যার আগে এবং ভোরে এডিস মশা বেশি বেশি কামড়ায়। এ কারণে সন্ধ্যার আগে ঘুমালেও মশারি টাঙাতে হবে। না হলে কিন্তু ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে। আর আগেই বলেছি, এখন জ্বর হলে শুরুতেই চিকিৎসকের কাছে যান। অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না। নিজে নিজে এন্টিবায়োটিক, এসপিরিন, ক্লোফেনাক এসব ব্যথার ওষুধ খেতে যাবেন না। বেশি বেশি পানি খান। খাবার স্যালাইন, তরল খাবার, স্যুপ খান। স্বাভাবিক সব খাবারও খেতে খাকুন। আর এ সময়ে জ্বর হলে অবশ্যই বিশ্রামে থাকতে হবে।
২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু জ্বর শুরু হওয়ার পর ২০০৩ সাল অবধি এটা প্রাণঘাতি ছিল কিছুটা। তারপর থেকে এ অবধি এতে আক্রান্ত হলেও তেমন কোনো মৃত্যুঝুঁকি ছিল না। কারণ জনসচেতনতা বেড়েছে এ সময়ে। চিকিৎসকরাও তার করণীয় সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তবে, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকৃতি বেশ উদ্বেগজনক। হতে পারে, ভাইরাস তার ধরন বদলেছে। ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তা একটা ঝুঁকি তৈরি করতে পারছে। তাই এটা নিয়ে জোরদার গবেষণা হওয়া দরকার।
সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার প্রতিরোধ করাটাই সবসময়ের জন্য উত্তম। এজন্য এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে সংস্থাগুলোকে সক্রিয় থাকতে হবে সব সময়ে। সেই সাথে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধ করা সম্ভবপর হবে।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/আরআইপি