নিচে ভাঙ্গা চেয়ার। ওপরে খোলা আকাশ। কখনো রোদে গা পুড়ছে, কখনো বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। তারপরও মাঠে চোখ স্থির রেখে ফুটবল খেলা দেখছেন মানুষ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে দর্শকদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না আর দুই-আড়াই বছর পর। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি যাই থাক হোম অব ফুটবলের গ্যালারিতে বসে নির্বিঘ্নে খেলা দেখতে পারবেন সবাই। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে নতুন রূপে দাঁড়াবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম বাংলাদেশের খেলাধুলার কালের স্বাক্ষী। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরে নতুন নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে, হচ্ছে। তবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে তার আপন মহিমায়। দেশের প্রধান ও ঐতিহ্যবাহী এ স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে খেলাধুলার সবচেয়ে বড় বলয়। দেশে যতো খেলা প্রচলিত তার সিংহভাগের চর্চাই হয়ে থাকে এ স্টেডিয়াম অঙ্গনে।
যুগে যুগে বহুবার সংস্কার হয়েছে দেশের প্রধান এই স্টেডিয়ামটি। যার বেশিরভাগ সংস্কারই হয়েছে খেলাধুলার কোনো আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া আসরকে সামনে রেখে। সর্বশেষ বড় ধরনের সংস্কার হয়েছিল ২০১১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য। প্রায় ৩২ কোটি টাকার সংস্কারে নতুনভাবে সেজেছিল দেশের প্রধান এই ক্রীড়াভেন্যু।
এই প্রথম স্টেডিয়াম সংস্কার হচ্ছে কোনো টুর্নামেন্টকে উপলক্ষে না করেই। দেশের প্রধান ক্রীড়াভেন্যু বলেই সরকার আরো উন্নত ও আধুনিকভাবে স্টেডিয়াম সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যে সংস্কারের কাজ শুরু হবে নতুন বছরের শুরুর দিকেই। শেষ হবে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে। ব্যয় আর সৌন্দয্যে অতীতকে ছাড়িয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কার।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম অধিকতর উন্নয়ন নামে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারের ব্যয় হবে ৯৮ কোটি টাকার মতো। গত বছরের প্রথম দিকে স্টেডিয়াম সংস্কার কাজের ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) তৈরি করেছিল। তখন বাজেট ছিল ৮০ কোটি টাকার মতো। সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে; কিন্তু এ বছর মার্চে হঠাৎ করেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্টেডিয়াম সংস্কার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে।
এত অর্থ ব্যয়ের সংস্কার নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে সে জন্য ফুটবল ও অ্যাথলেটিকসহ বিভিন্ন ফেডারেশনের মতামত নিয়ে নতুন করে ডিপিপি তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। যে কারণে, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নতুন করে পরিকল্পনা সাজায়। তাতে ব্যয় বাড়ে দুই দফা। ৮০ কোটি টাকার বাজেট প্রথমে হয় ৯০ কোটি টাকা। পরে আরো বেড়ে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা।
নতুনভাবে তৈরি করা ডিপিপি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হয়ে এখন আছে পরিকল্পনা কমিশনে। বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা কমিশনের সভায় অনুমোদন হতে পারে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কার প্রকল্প। তারপর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে দরপত্র আহবানের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)।
স্টেডিয়ামের মূল কাঠামো ঠিক রেখেই করা হচ্ছে এ সংস্কারযজ্ঞ। যেখানে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে গ্যালারির দর্শকদের রোদ-বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সুকুমার সাহা জাগো নিউজকে জানান, ‘সবচেয়ে বেশি, ২০ কোটি টাকার মতো লাগবে গ্যালারিতে শেড বসাতে। চেয়ার বসাতে লাগবে ৮ কোটি টাকার মতো। একই রকম ব্যয় হবে ফ্লাডলাইট পরিবর্তন করতে। অ্যাথলেটিক ট্র্যাক স্থাপনের জন্য খরচ আছে ১৯ কোটি টাকার মতো।’
Advertisement
গ্যালারি ও ভিআইপির চেয়ার সরিয়ে সেখানে বসানো হবে উন্নতমানের নতুন চেয়ার। এর মধ্যে ভিআইপি গ্যালারিতে বসানো হবে ফোল্ডিং চেয়ার। বদলে ফেলা হবে স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইট। তবে ফ্লাডলাইটের টাওয়ার অপরিবর্তিত থাকবে। শুধু বদলে ফেলা হবে বাতি। প্রথমে এলইডি বাতি লাগানোর পরিকল্পনা ছিল। নতুন পরিকল্পনায় স্থাপন করা হবে জি-থ্রি ভারসনের বাল্ভ। এর মাধ্যমে আলো ও সৌন্দর্য দুটিই বাড়বে।
ফ্লাডলাইট, শেড, চেয়ার এবং অ্যাথলেটিক ট্র্যাকের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু কাজ আছে এ সংস্কারের আওতায়। ড্রেসিং রুমগুলোর আধুনিকায়ন, খেলোয়াড়দের জন্য জিম সুবিধা বৃদ্ধি, ডোপটেস্ট রুম নির্মাণ, মিডিয়া সেন্টার আধুনিকায়ন, টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য ক্যামেরা স্ট্যান্ড তৈরি ও স্কোর বোর্ড ঠিকঠাক করা।
নতুন পরিকল্পনায় আগের চেয়ে বেশি ব্যায়ে রাখা হয়েছে জিমন্যাশিয়াম তৈরির জন্য। আগে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ টাওয়ারে একটি জিম করার পরিকল্পনা ছিল। এখন সেটা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামই আরো আধুনিক করা হবে সরঞ্জামাদী বাড়িয়ে।
একটি আর্কাইভও থাকছে নতুন পরিকল্পনায়। স্টেডিয়ামের যে কোনো একটি কক্ষ ব্যবহার করা হবে আর্কাইভ হিসেবে। দেশের খ্যতমান ক্রীড়াবিদদের ছবি, তাদের ব্যবহারের জিনিসপত্র, ট্রফি, মেডেল, জার্সিসহ খেলাধুলার নানা সরঞ্জামাদী শোভা পাবে এই আর্কাইভে।
পাইপ দিয়ে মাঠে পানি দেয়ার দৃশ্য আর দেখা যাবে না। মাঠে পানি দেয়ার জন্য আধুনিক পদ্ধতি আসছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। হকির টার্ফে যেভাবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পানি দেয়া হয়ে থাকে সেভাবেই ভেজানো হবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠ। পুরো মাঠ ভেজাবে ৬ টি গানপয়েন্টের পানি।
স্টেডিয়ামের হসপিটালিটি বক্সগুলো থাকবে। তবে সবগুলো আছে সংস্কারের আওতায়। দক্ষিণ গ্যালারির লাল রঙের আইসিসি নামের বক্সটি থাকলেও বদলে যাচ্ছে ওটার নাম। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বক্সের নতুন নাম দিচ্ছে ভিআইপি বক্স। মজার বিষয় হলো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নাকি ওই বক্সের নাম বদল ছাড়া স্টেডিয়াম সংস্কার নিয়ে তেমন কোনো চাহিদার কথা বলেনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে। শুধু স্টেডিয়ামই নয়, এর চারপাশের রাস্তাও উন্নত করা হবে। এক কথায় পুরো স্টেডিয়াম ও তার আশপাশেও লাগবে রঙের ছোঁয়া। বিশাল ব্যয়ের বড় ধরনের সংস্কারে বদলে যাবে দেশের প্রধান এ স্টেডিয়ামের চেহারা।
আরআই/আইএইচএস/আরআইপি