বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন কারণে নিজেকে সমালোচনায় জড়িয়েছেন একের পর এক উপাচার্য। তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। উঠে এসেছে অনিয়ম-দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার খবরও। যার ফল ভোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।
Advertisement
জানা গেছে, দুর্নীতির মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল জলিল মিয়া খেটেছেন জেল। আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন-নবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। যোগদান করেন গত বছরের ১৪ জুন। এরই মধ্যে এই উপাচার্যের বিরুদ্ধেও উঠেছে নানা অভিযোগ।
সপ্তাহে দু-এক দিন ক্যাম্পাসে থেকে আবার ঢাকায় চলে যান। কোনো কোনো সময় ঢাকা থেকে সকালের ফ্লাইটে সৈয়দপুরে নেমে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবার ওইদিন বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকায় চলে যান। ধারাবাহিক এমন অনুপস্থিতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর দাবি করে আসছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার মাধ্যমে নজির সৃষ্টি করছেন। ক্যাম্পাসে না থাকলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকাস্থ লিয়াজোঁ অফিস এবং অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সারেন।
Advertisement
অথচ রাষ্ট্রপতি ও আচার্য তাকে যে চারটি শর্তে নিয়োগ দিয়েছেন, তার একটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উপাচার্যকে সার্বক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতে হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের জন্য বাড়ি করে দিয়েছে সরকার।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান উপাচার্য কোষাধ্যক্ষ, ডিনসহ আঁকড়ে আছেন অতিরিক্ত ৬টি পদ। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের ডজন খানেক বিষয়ে ক্লাস নেন তিনি। এসব ক্লাস চলে মাঝরাত পর্যন্ত। গত ৯ সেপ্টেম্বর মাঝরাত পর্যন্ত ক্লাস নেয়া বন্ধে উপাচার্য বাসভবন ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশের উপস্থিতিতেই উপাচার্য বাসভবন লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়েন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ দেয়ায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মধ্যে পড়েন উপাচার্য। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বাধ্য হন সেই শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে। একই সঙ্গে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তিতে জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও বিচার না করার অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। বিষয়টি প্রমাণিত হলেও ভর্তি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জানা গেছে, কখনও উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে উপাচার্যকে অপসারণের দাবি, কখনও বা নিজেদের সুবিধা আদায় না হওয়ায় উপাচার্যকে অসহযোগিতা। এসবের মূলে রয়েছে উপাচার্যদের নৈতিকস্থলন।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনিক পদ ও আর্থিক সুবিধা পেতে উপাচার্যদের কেন্দ্র করে বিভক্ত হচ্ছেন শিক্ষকরা। পাঠদান থেকে শিক্ষক রাজনীতিতে বেশি সময় দেন নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ফলে বেড়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকাল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের মধ্যে বিজনেস স্ট্যাডিজ অনুষদ ছাড়া বাকি পাঁচটি অনুষদেই সেশনজট লাগামহীন। এর মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদের দায়িত্বে খোদ উপাচার্যই। এসব অনুষদের অধিকাংশ বিভাগেই চার বছরে স্নাতক শেষ হচ্ছে না ছয় বছরেও। এক বছরের স্নাতকোত্তর শেষ করতে সময় লাগছে দেড় থেকে দুই বছর।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করা শর্তে জাগো নিউজকে জানান, চার বছরের স্নাতক তাদের ছয় বছরেও শেষ হচ্ছে না। গণিত বিভাগের স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, চার বছরের স্নাতক এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর শেষ করতে সময় লাগছে প্রায় আট বছর।
ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে জানান, চার বছরের স্নাতক শেষ করতে সময় লাগছে সাড়ে ৭ বছর। ওই বর্ষের ষষ্ঠ সেমিস্টারের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার সাড়ে ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও আজো ফল প্রকাশ হয়নি। ফলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না সপ্তম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা।
এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলছেন, সেশনজটের কথা বললেই ফেল করিয়ে দেয়াসহ ফলাফল খারাপ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এসব নিয়ে কথা বলায় ফল খারাপ করে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে। ফলে ভয়ে মুখ খুলছেন না তারা।
এজন্য ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা দায়ী করছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান উপাচার্যকেই। শিক্ষার্থীদের দাবি, একমাত্র উপাচার্যই পারেন সেশনজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা নিতে। সেশনজট নিরসনে উপাচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এমন নেতিবাচক সংবাদ শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করেছে। উপাচার্যদের অসততার ভার বইতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় একজন আন্দোলনকারী ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগরের সভাপতি অধ্যক্ষ ফকরুল আনাম বেনজু জাগো নিউজকে বলেন, উপাচার্য একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক, শিক্ষক এবং অভিভাবক। তার অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সেশনজট ভয়াল রূপ ধারণ করেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে মঙ্গলবার বিকেলে ৪টা ৩৯ মিনিটে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মুঠোফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এরপর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চেয়ে ফোন রিসিভ করার অনুরোধ জানিয়ে ৪টা ৪৬ মিনিটে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। বিকেল ৫টায় আবারও কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায় এবং ৬টা ৫০ মিনিটে আবারও কল দিলে সংযোগ চালু থাকলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এমএএস/আরআইপি