‘ফিফা আজ (সোমবার রাতে) যেভাবে দূর্গতের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছে , আমি গেলেও দুই একটা ত্রাণ পাইতাম আজ রাতে....। তয় মেসি-রোনাল্ডো ফ্যানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরী না করায় এই বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিফাকে দেওয়ার সুপারিশ করছি। ফিলিং মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর, নো মেসি নো রনাল্ডো।’
Advertisement
ফিফা দ্য বেস্ট অ্যাওয়ার্ড নাইটের পর মুহাম্মদ নুরুল করিম নামে এক সরকারী কলেজের শিক্ষক এবং ফুটবল ভক্ত ফেসবুকে লেখেন তার নিজের অনুভুতি। সত্যিই তো, চাইলে আপনিও ফিফার অনাড়ম্বর গালা অনুষ্ঠানে পুরস্কার জিততে পারতেন।
কীভাবে? এক কাজ করবেন, প্রথমে বাংলাদেশের কোন এক পর্যায়ের লিগে একটা গোল করবেন। সেই গোলটার একটা সুন্দর ভিডিও করার দায়িত্ব দিবেন কাউকে। অতপর সেই গোলের ভিডিও পাঠিয়ে দেবেন ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার কাছে। এরপর যখন ফিফা সেরা গোলের জন্য সবার ভোট চাইবে তখন কিছু টাকা পয়সা খরচ করে সেই গোলকে ভোট দেওয়ার জন্য একটা ক্যাম্পেইন করবেন। বাংলাদেশের তো ৮ কোটি মানুষ ইন্টারনেট চালায়। সে ক্ষেত্রে ৮ কোটি না হোক, অন্তত ৪ কোটি মানুষকে সেই গোলের ভিডিওতে ভোট দেওয়ানো যেতে পারে। ব্যাস! কাজ শেষ। দেখা যাবে সেই গোলটাই জিতে নিয়েছে ফিফা বর্ষসেরা গোলের পুরস্কার!
ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড মূলতঃ দেয়া হয় বছরের সেরা গোলটিকে; কিন্তু ২০১৮ সালের ফিফা বর্ষসেরা অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান এক বস্তা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আবারো প্রশ্ন উঠেছে সেরা খেলোয়াড়, সেরা একাদশ, সেরা গোলের জন্য পুরস্কার দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে।
Advertisement
শুরুতেই উদাহরণ দিয়েছি ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড নিয়ে। ২০০৯ সালে থেকে প্রতি বছর দেওয়া হচ্ছে এই পুরস্কার। এক বছরের জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের জুলাই পর্যন্ত হওয়া সবগুলো গোল থেকে নির্বাচিত করা হয় বছরের সেরা গোলদাতাকে।
এবারের ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল ১০টি গোল। যেখানে রোনালদোর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে করা বাইসাইকেল কিকে করা অসাধারণ গোলটিও (যা ইতোমধ্যে ইউরোপের সেরা গোলের পুরস্কার জিতে নিয়েছে) ছিল। ছিল গ্যারেথ বেলের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে বাইসাইকেল কিকে করা গোল এবং বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির অসাধারণ ফিনিশিং গোলটিও ছিল। কিন্তু তাদের সবাইকে টপকে ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন লিভারপুলের মোহামেদ সালাহ; কিন্তু তার করা গোলটি কি আসলেই পুসকাস অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্য ছিল? সেটি নিয়েই শুরু হয়েছে যত বিতর্ক।
একজন সাধারণ মানুষের চোখে মোহামেদ সালাহর গোলের থেকে শীর্ষে থাকা বাকি ৯টা গোলই ঢের সুন্দর এবং পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলেই মনে হবে। মূলতঃ ফিফার ভোটিং প্রক্রিয়ার কারণেই এই পুরস্কার জিতেছেন মোহামেদ সালাহ। সেরা গোলটি নির্বাচন হয়েছে সমর্থকদের ভোটে। এখন সারা ইংল্যান্ড তথা লিভারপুল তথা মিসরের মানুষ সালাহকেই ভোট দিয়েছে।
তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে সালাহর বাজে ইনজুরিতে ক্রন্দনরত অবস্থায় মাঠ ছাড়ার দৃশ্য একটু বেশিই নাড়া দিয়েছিল ফুটবল ভক্তদের। সেখানে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকেও মানুষ ভোট দিয়েছে সালাহকে। আর এ কারণেই মূলতঃ সেরা গোলের পুরস্কারটি জিতেছেন লিভারপুলের মিসরীয় ফুটবলার মোহামেদ সালাহ। এটা তো গেল একটি অ্যাওয়ার্ড। এবার বাকি অ্যাওয়ার্ডেও নজর দেওয়া যাক।
Advertisement
ফিফার বর্ষসেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জিতেছেন বেলজিয়ামের থিবো কুর্তোয়া। তার পারফরম্যান্স নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। বেলজিয়ামকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠাতে গোলবারের নিচে অতন্দ্র প্রহরীর মত ছিলেন এই রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। ইউরোপের বর্ষসেরা গোলরক্ষকেরও পুরস্কার জিতেছেন তিনি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে আরেক জায়গায়। যে ফিফার বর্ষসেরা গোলরক্ষক হয়েছে তার জায়গা অবধারিতভাবেই ফিফার সেরা একাদশে থাকার কথা; কিন্তু ফিফা যখন তাদের বর্ষসেরা একাদশ ঘোষণা করলো, তখন সবার চোখ কপালে ওঠার পালা!
কুর্তোয়ার পরিবর্তে ফিফার বর্ষসেরা একাদশে গোলরক্ষক হিসেবে জায়গা পেয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্প্যানিশ গোলরক্ষক ডেভিড ডি গিয়া। যে বর্ষসেরা গোলরক্ষক হলো, সে যদি সেরা একাদশেই জায়গা না পায়, তাহলে কিসের ভিত্তিতে তাকে সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার দেওয়া হলো- এটা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বোদ্ধাদের মনে। এখানেও সেই সমর্থকের ভোটে সেরা গোলরক্ষক হয়েছেন কুর্তোয়া। কিন্তু ফিফার তো একটা মস্তিষ্ক আছে। তাদের সেই মাথাতে কী আদৌ কাজ করেনি, যে সেরা গোলরক্ষক হলো সেই সেরা একাদশে থাকার যোগ্য!
বিতর্ক আরো জন্ম দিয়েছে এবারের ফিফা বর্ষসেরা একাদশ নিয়ে। লিওনেল মেসি, যিনি কিনা গেল দশ বছর টানা ফিফার সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় শীর্ষ তিনে ছিলেন, তিনি এবারের সেরা তিনেই জায়গা পাননি। অথচ গেল মৌসুমে ইউরোপের সব লিগের মধ্যে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তিনি।
মেসির না থাকা নিয়ে শুরু থেকেই নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। সেরা তিনে মদ্রিচ, রোনালদো এবং সালাহ সুযোগ পান। যেখানে ফিফা সেরা তিনজনকে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনয়ন দিয়েছে, সেখানে তাদের সেরা একাদশে থাকাটা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়; কিন্তু ফিফার একাদশ দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়! ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় তিন নাম্বার হয়েছেন মোহামেদ সালাহ; কিন্তু সেরা একাদশে সেই সালাহরই নাম নেই! সালাহর পরিবর্তে জায়গা পেয়েছেন বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করা এডিন হ্যাজার্ড। অন্যদিকে সেরা তিনে না থেকেও ফিফার একাদশে জায়গা পেয়েছেন লিওনেল মেসি!
শুধু তাই নয়, ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেরা তিনজনের নাম আগেই ঘোষণা হয়েছিল। সেখান থেকে সেরা বাছাই করে নেয়া হয়েছে লুকা মদ্রিচকে। প্রশ্ন উঠেছে, কিসের ভিত্তিতে মদ্রিচ সেরা হন? বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স না ক্লাব ফুটবলের পারফরম্যান্স? যদি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সই ধরা হয়, তাহলে ২০১৪ সালে মেসি না পেয়ে রোনালদো কিভাবে পেলো। ২০১০ সালে ইনিয়েস্তা না পেয়ে মেসি কিভাবে পেলো?
আর যদি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পারফরম্যান্স ধরা হয়, তাহলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর আশ-পাশেও কেউ থাকতে পারার কথা নয়। সেখানে লুকা মদ্রিচ তো অনেক পরের কথা। আবার অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যদি রিয়াল ছেড়ে জুভেন্টাসে না যেতেন, তাহলে কি পুরস্কারটা সত্যিই মদ্রিচের হাতে উঠতো? অর্থ্যৎ, পুরস্কারটা হয়ে গেছে পুরোপুরি ফিফার ইচ্ছা নির্ভর। যাকে ইচ্ছা তাকেই দিচ্ছে। যেন মামা বাড়ির আবদার। যখন যেখানে যাকে দরকার সেখানে তাকে বসিয়ে দিচ্ছে ফিফা।
২০১৬ সালে ফ্রেঞ্চ ফুটবল ম্যাগাজিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আলাদাভাবেই ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার দেওয়া শুরু করে। তখন থেকেই কোন না কোন পুরস্কার দেওয়া নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ফিফা। কিন্তু এবার যেন সব কিছুকেই হার মানিয়েছে। এদিক দিয়ে বলতে গেলে ইউরোপের ‘দ্যা বেস্ট মেন’স অ্যাওয়ার্ড’ অনুষ্ঠানটি ঢের গ্রহণযোগ্য। যেখানে সবকিছু নির্বাচনের দায়িত্বে থাকেন প্রতিথযশা সাংবাদিকরা। আর ফিফায় সব নির্বাচন করে সমর্থকরা। যেখানে সবসময় আবেগের ছড়াছড়ি। দিন শেষে আস্তে আস্তে ফিফার অনুষ্ঠান যেন কৌতুক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামীবারও হয়তো এই কৌতুক অনুষ্ঠানে সেরা হওয়ার জন্য লড়াই করতে দেখা যাবে অনেককে।
সালাহর গোলের ভিডিও:
আরআর/আইএইচএস/পিআর