মতামত

রাষ্ট্র বনাম বিচারপতি সিনহা : প্রশ্নের জবাব চাই

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার পর থেকেই তার পরিচিত অনেকেই অপেক্ষা করেছিলেন যে, তিনি একটি বোমা ফাটাবেন এবং তা সরকারকে বিপাকে ফেলবে। বিশেষ করে তার দেশত্যাগ এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থানকালে পরিচিতজনদের কাছে তিনি একথা অত্যন্ত জোরেশোরেই বলে আসছিলেন যে, তিনি একটি বই লিখে সবকিছু “ফাঁস” করে দেবেন।

Advertisement

এর অর্থ হলো তার কাছে ফাঁস করার মতো তথ্য ছিল এবং তিনি সেটা করেছেন, একটি বই লিখে অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যে কেউ চাইলেই বইটি ডাউনলোড করে পড়তে পারেন। দীর্ঘ বই এবং দুর্বল সম্পাদনার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ বোঝা দুস্কর। তবুও বইটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিচারপতি সিনহার বিশ্লেষণ বটে, এবং সে কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখা বিচারপতি সিনহার বইয়ের রিভিউ নয়, বরং এই বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আমরা যে সময়ে বসবাস করছি সে সময়ের বিশ্লেষণ।

বইটির মূল বক্তব্য যদি বুঝে থাকি তাহলে তিনটি বাক্যে সেটা বোঝানো যায়। এক. বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়, দুই. সরকার এমনকি সরকার-প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাও বিচারপতি সিনহার ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন ষোড়শ সংশোধনী বিলটি যাতে পাস না করানো হয় সে জন্য এবং তিন. বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতির পদ থেকে চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।

এছাড়াও অনেক কিছুই এই বইটিতে আছে (এখনও সম্পূর্ণ পড়া সম্ভব হয়নি আমার, আমি কয়েকটি অধ্যায়-পাঠে এটুকু বুঝেছি) যা নিয়ে নিশ্চয়ই আরো বিচার-বিশ্লেষণ প্রকাশিত হবে অচিরেই।

Advertisement

বিচারপতি সিনহা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত প্রধান বিচারপতি। এ কারণেই তিনি আলোচিত যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে সাংবিধানিক পদে তিনিই প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি। দ্বিতীয়তঃ তিনি নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই প্রতিটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শুরু থেকেই রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং গণমাধ্যমে তার বক্তব্য বার বার শিরোনাম হয়েছে।

তিনি ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সে জন্য তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এ কারণেও তিনি আলোচিত ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ১/১১-র আমলে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল এবং অলৌকিক কারণে তিনি সেই সময় মুক্ত থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু এসব কোনো তথ্যই আমরা তার প্রকাশিত বইতে দেখি না। আমরা তার বইটি পাঠে এই তথ্যও জানি না যে, তিনি কেন প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করেই রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেছিলেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতোই গণবক্তৃতা রাখতেন।

এ বিষয়ে তখনই অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছিলেন তিনি ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের পর। তিনি সরকারের অবস্থানের বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন এবং সরকারও রায়টি বাস্তবায়নে গড়িমসি করছিলো। টালবাহানায় সময় ক্ষেপণকেই কৌশল হিসেবে সরকার বেছে নিয়েছিল বলে আমরা বুঝতে পারছিলাম।

কিন্তু সেই সময়, অর্থাৎ গোটা ২০১৭ সালের প্রথমার্ধ জুড়ে বিচারপতি সিনহা যেখানেই গিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন সেখানেই জোর গলায় বলেছেন যে, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। ধরুন ২০১৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার মির্জাপুরে একটি মন্দিরের বার্ষিক উৎসবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন যে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তিনি এই স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার কাজটি করে যাচ্ছেন। তিনি এ সময় হিন্দুদেরকে বলেন আজানের সময় ঢাকঢোল না বাজাতে এবং মুসলমানদের বলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনে সহযোগিতা করতে।

Advertisement

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধ পরিকর। তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশে আর কখনও কোনো সামরিক আইন প্রশাসক ক্ষমতা দখলের সুযোগ পাবেন না। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, আগের মতো বিচার বিভাগ এখন আর রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গ নয়, রাষ্ট্রের অঙ্গ এবং হান্ড্রেট পার্সেন্ট স্বাধীন।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এসে বিচারপতি সিনহা যে আর সে কথা বলছেন না সেটা বাংলাদেশের দুধের শিশুটিও জানতে পেরেছে কারণ একটি পক্ষ মনে করছে যে, বিচারপতি সিনহার বইটিই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ও কঠিন অস্ত্র, যা তারা যথেচ্ছ ব্যবহার করতে চাইছে। আর সরকার নিজে ও সরকার-সমর্থক পক্ষটি অবিরাম বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে বহুবিধ অভিযোগের তীর ছুঁড়ে চলেছেন।

এগুলো কেন আগে প্রকাশ করা হয়নি সে প্রশ্ন যেমন উঠেছে তেমনই সরকার এসব জেনেও কেন বিচারপতি সিনহাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল সে প্রশ্নকে কেউ আর অপ্রত্যাশিত মনে করছেন না। কিন্তু তার চাইতেও বড় প্রশ্ন হলো, সরকার যদি এতো কিছু জানতোই বিচারপতি সিনহা সম্পর্কে তাহলে কেন তাকে বিদেশে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো? কেন তাকে বিচারের আওতায় আনা হলো না? বিচারপতি সিনহার বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই প্রশ্নটিই সবচেয়ে যৌক্তিক এবং এর উত্তর সরকার দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়, ফলে সিনহা ইস্যুতে সরকার মূলতঃ বেশ বেকায়দা অবস্থানেই পড়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে।

বোঝাই যাচ্ছে যে, ২০১৭ সালের মধ্যভাগে এসেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে এবং বহু রকমের গুজব বাতাসে ভাসতে থাকে। বিশেষ করে সরকারকে বিপাকে ফেলা বা সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য যখন একটি পক্ষ নির্বাচনের পরদিন থেকেই কাজ শুরু করে তখন সরকার সব সময়ই ‘এই বুঝি কেউ ধাক্কা দিলো’-ধরনের আতঙ্কে ভোগে। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সিনহা সাবেকও যখন ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেছিলেন তখন থেকে সরকারও যে বেশ বিপাকে পড়েছিল তাও সকলেই দেখেছে।

দু’পক্ষের টানাপড়েনের মধ্যেই এই তথ্যও প্রচার পাচ্ছিলো যে, বিচারপতি সিনহা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন এবং একটি বিচার বিভাগীয়-ক্যু ঘটিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে অবৈধ অর্থাৎ চলমান সংসদকেই অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন।

বিচারপতি সিনহা পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে যে উদাহরণের কথা প্রকাশ্যেই উচ্চারণ করছিলেন তাতেই বোঝা গিয়েছিল যে, তিনি কোন্ পথে হাঁটছেন। তিনি যদি সে পথে নাও হেঁটে থাকেন তাহলেও কোনো ভাবেই সরকার কি এরকম ঝুঁকি নিতে পারতো যেখানে তাদেরকেই ফেলে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়? ফলে দু’পক্ষের মধ্যে টানাপড়েন দেশের বিচার বিভাগকেই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

একজন প্রধান বিচারপতিকে তার দুর্নীতির জন্য কিংবা তার অন্যায্য কাজের জন্য সরিয়ে দেওয়ার নজিরও আর কখনও ছিল না, যদিও এদেশে প্রধান বিচারপতিরা সামরিক সরকারকে বৈধতা দেওয়ার কাজটিও নির্বিঘ্নে করেছেন। বিচারপতি সিনহার সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির সম্মানজনক সমাধান এবং বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য আনয়নের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই দিয়েছিলেন বলে আমরা ২০১৭ সালের মধ্যভাগের পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই। কিন্তু এসব কিছুই ঘটেনি।

কয়েকদিনের চরম নাটকীয় ঘটনার পর আমরা জানতে পারি যে, প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে তার সেই প্রস্থান মসৃণ ছিল না। একটি চিঠি যার মাধ্যমে তিনি পদত্যাগ করেন সেটি তার লেখা নয় বলে সে সময় কথা উঠলেও তিনি কিন্তু তার বইয়ে সে চিঠি বিষয়ে প্রায় কিছুই বলেননি।

কিন্তু তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এনেছেন, তার জবাব এখন রাষ্ট্রকে দিতেই হবে। সেটি হলো, তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রাষ্ট্রের সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা তার ওপর চাপ দিয়েছিলেন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে রায় না দেওয়ার জন্য।

বিচারপতি সিনহার বইয়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিযোগ এটাই। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো বক্তব্য আমরা পাইনি। আমার মনে হয় এ বিষয়ে রাষ্ট্রের একটি বক্তব্যই পারে বিচারপতি সিনহার সমস্ত অভিযোগের জবাব।

এবং এই জবাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে কেন মাত্র দশ মাস আগেও যেখানে বিচারপতি সিনহার কাছে দেশের বিচারবিভাগ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন, সেখানে এখন কেন বিচারবিভাগকে কেবল পরাধীন বলেই তিনি থামেননি, তিনি আরও অনেক দূর গিয়ে রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ ধরেই নাড়া দিয়েছেন?

একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি বার বার শপথ ভঙ্গ করেছেন, এই বইটির পরতে পরতে সে তথ্য আমরা পাই কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন হলো, সে কারণে কেন তাকে বিচারের আওতায় আনা হলো না বা হবে না? রচেস্টার ২৪ সেপ্টেম্বর, সোমবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/পিআর