ভোরের আভায় চোখে-মুখে যেন উচ্ছ্বাসের ছটা। হাসপাতালের বিছানা থেকে মুক্তি মিললেই খেলার মাঠে আলো ছড়াবে অদ্রিকা। কিন্তু নিদারুণ যন্ত্রণায় সব আলো যেন ফ্যাকাশে হয়ে আছে তার। চোখ লাল, দুর্বল শরীর, হাতে ক্যানোলা। প্রায় অনাহারে থাকা শিশুটি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। সর্বনাশা ডেঙ্গু অদ্রিতার সব সুখ যেন কেড়ে নিয়েছে।
Advertisement
রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। ভিকারুন্নেসা স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে অদ্রিতা। গত বৃহস্পতিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। ২২ সেপ্টেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল রোববার দুপুরের পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অদ্রিতার মা তাকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সে খেতে চাচ্ছে না। কান্না আসছে কিন্তু কাঁদতে পারছে না।
অদ্রিতার মা জানান, মাঝে হঠাৎ প্রচুর গরম পড়েছিল। বাসায় এসি ছেড়ে মশারি না টানিয়েই ঘুমাতে বাধ্য হয়েছি। ফলও পেলাম। ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো।
একই হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে ডেঙ্গু রোগী ইসমাইল হোসেনের দেখা মেলে। বয়স ৩১। রাজধানীর মিরপুরে বাসা। একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন। এখন তিনি নিজেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি। গত এক সপ্তাহ ধরে এখানে, এর আগে ছিলেন আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে ‘তেমন ভালো’ চিকিৎসা না পেয়ে এখানে আসা।
Advertisement
ইসমাইল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্লাটেলেট (অণুচক্রিকা) অনেক কমে গিয়েছিল। চিকিৎসকদের পরামর্শে চার ব্যাগ রক্ত দিয়েছি। এখন প্লাটেলেট বেড়েছে, কিন্তু পেট ফুলে গেছে। বসে থাকতে কষ্ট হয়। বাধ্য হয়ে শুয়ে আছি, শরীরে ব্যথাও আছে। দু-তিনদিন জ্বর আসেনি। তবে একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছি।
জানা গেছে, হাসপাতালটিতে বর্তমানে ১৮ জন বিভিন্ন বয়সী ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী আসছেন। তবে রোববার মাত্র একজন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু নিয়ে রিপোর্ট করেন অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বৃষ্টি শুরুর পর থেকে সাধারণত এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ বছরের জুনে হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন ৫০ জন, জুলাইয়ে ৭৩ জন, আগস্টে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ জনে। এর মানে ওই তিন মাসে ২১৩ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে গত জুনের ২৫ তারিখে ৭০ বছর বয়সী এক রোগী মারা যান।
এ বিষয়ে হাসপাতালের মেট্রন (সেবা, তত্ত্বাবধায়ক) গোলাপী হালদার জাগো নিউজকে জানান, সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ পর্যন্ত ৫১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং চিকিৎসা নিয়েছেন। জ্বর নিয়ে অনেকেই ভর্তি হন, কিন্তু আমরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হলে রিপোর্টে লিপিবদ্ধ করি না। কোন রোগীর কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, সেটাও রিপোর্টে লিপিবদ্ধ হয়।
Advertisement
হাসপাতালটির রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভর্তি হওয়া প্রায় সবারই হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বর, শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা, খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব এবং পেটে যন্ত্রণা ছিল। অনেক শিশুর সারা শরীরে হামের মতো ফুসকুড়িও দেখা যায়। বড়দের অনেকের ত্বকে কালচে দাগ, নাক, মুখ, মাড়ি থেকে রক্ত বের হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির উপ-পরিচালক প্রফেসর ড. স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগীরা খুব দুর্বল অনুভব করেন। এই দুর্বলতা দীর্ঘ সময় থাকে। তাই খাবার ও চলাফেরায় সচেতন হতে তাদের পরামর্শ দেয়া হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের আশপাশ থেকেই বেশি রোগী আসে। নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল কোন স্থানের লোক বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আমার মনে হয়, সবাই কাছাকাছি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।
চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে সবার আগে প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। বাড়ির পানির ট্যাংক, চৌবাচ্চা, এয়ার কুলার এবং বাড়ির অনান্য জলাধারের পানি সপ্তাহে একদিন খালি করে শুকিয়ে নিতে হবে এবং সর্বদা ঢেকে রাখতে হবে। এছাড়া সারা শরীর ঢাকা থাকে এমন পোশাক পরতে হবে এবং রাতে ও দিনে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারির ব্যবহার জরুরি।
কিন্তু এসব নিয়ম মেনেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার নজির মিলছে। রাজধানীর মগবাজারে আদ-দ্বীন হাসপাতালে রোববার সকালে জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু নিয়ে কমপক্ষে ছয়জন রোগী ভর্তি। তাদের মধ্যে একজন ২৩ বছর বয়সী ইমরান খান।
পাশে থাকা তার ভাবি ঝুমুর বলেন, শাহজাদপুরের বাসায় আছি সাত বছর ধরে। বাসায় কখনও মশার উপস্থিতি ছিল না। কেউ মশাবাহিত জ্বর বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্তও হয়নি। এরপরও ইমরান ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলো। পাঁচদিন ধরে হাসপাতালে। তার প্লাটেলেট ৪৮ হাজারে নেমে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, ইমরান চাকরি করে গুলশানে। আমার মনে হয় অফিসেই মশায় আক্রান্ত হয়েছে সে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. শ্রাবণী বলেন, প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী আসছে। গড়ে ৮-১০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, ছোট-বড় সব বয়সী মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মাহমুদা হাসান জাগো নিউজকে বলেন, গত মাসে এ আর রিজন নামে দুই মাসের এক শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখানে ভর্তি হয়। অনন্যা নামের ১৩ মাসের একটি শিশুও এই মাসে ভর্তি হয়। তবে তারা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছে।
তিনি বলেন, অনেক শিশুই আসছে। বেশ কয়েকজনের অবস্থা খারাপ ছিল। কিন্তু বড় কোনো ইনসিডেন্ট হয়নি। মারা যাওয়ার কোনো রেকর্ড এখানে নেই।
বাচ্চাদের বিষয়ে মা-বাবাকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে হাসপাতালটির শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. হামিদুর রহমান বলেন, ‘বাচ্চাদের শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি গরম অনুভূত হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। পরামর্শ ব্যতীত কোনো ওষুধ সেবন করানো যাবে না। এখন যেহেতু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই এটাই এখন সবচেয়ে বড় পরামর্শ। এর বাইরে শিশুদের তরল খাবার দিতে হবে। নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে।’
এমএ/এমবিআর/এমএআর/এমএস