মতামত

স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির ঐক্য!

ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া রাজনীতিতে নতুন ঢেউ তুলেছে। শনিবার মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন। মোটা দাগে তাগের লক্ষ্য- সরকারের পতন।

Advertisement

গণতান্ত্রিক সমাজে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে, জোট হবে; এটাই স্বাভাবিক। আরেকটা মজার ঘোষণা এসেছে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মঞ্চ থেকে। মজার না বলে বলা ভালো আমার স্বপ্নের ঘোষণা। আমি অনেকদিন ধরেই চেয়েছি, বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। বাংলাদেশের সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই হবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। তাহলে মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের দল বেছে নিতে পারবে।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর থেকে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির নেতৃত্বও আওয়ামী লীগের হাতেই। আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যতম সেক্টর কমান্ডার হলেও তার দলটি পরিণত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের আখড়ায়। এই দলের কল্যাণেই স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে উড়েছে জাতীয় পতাকা। জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন শাহ আজিজুর রহমানকে। আর তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মন্ত্রিত্ব উপহার দিয়েছেন মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মুজাহিদকে। এই তিন যুদ্ধাপরাধীই এখন মৃত।

আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর আগেই মরে বেঁচেছে শাহ আজিজ। আর নিজামী-মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলে মরতে হয়েছে। চার দশক পরে হলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ জাতির একটি গ্লানি মোচন করেছে। তারপরও বাংলাদেশের অনেকে একটা জটিল সমস্যায় ভোগেন। নানা কারণে বিরক্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাশেই থাকতে বাধ্য হন, এমন অনেক মানুষ আছেন বাংলাদেশে।

Advertisement

আওয়ামী লীগের ওপর রাগ করে বিএনপিকে ভোট দিলে যুদ্ধাপরাধীদের কেউ মন্ত্রী হয়ে যেতে পারে, এই শঙ্কায় ভোটের সময় নিরুপায় তারা। যদি বাংলাদেশে সরকারি ও বিরোধী দল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির হয়, তাহলে এই নিরুপায় মানুষগুলো স্বস্তি পাবে। কিন্তু সেই বিরোধী দল কী ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া? নাগরিক সমাবেশ থেকে এই ঐক্যকে 'স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির ঐক্য' হিসেবে দাবি করা হয়েছে?

সেই দাবি কতটা সত্য? জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোক্তা ড. কামাল হোসেন অবশ্যই স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের প্রথম আইনমন্ত্রী, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে একটা অসাধারণ সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিস্ফুটিত হয়েছিল। তবে তার মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের অবস্থান ও ভূমিকা রহস্যজনক।

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার নির্দেশনা নিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম আর ড. কামাল হোসেন। পথে ড. কামাল গাড়ি থেকে নেমে যান। বাকি দুজন অনেক বাধাবিঘ্ন পেড়িয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। এটা ব্যারিস্টার আমীরের বইয়ে আছে। ড. কামাল প্রতিবাদ করেছেন বলে শুনিনি। এপ্রিলে তিনি পাকিস্তান চলে যান।

কীভাবে গেলেন, তার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ভার্সন হলো, তিনি পাকিস্তানী হানাদারদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাকে শ্বশুর বাড়ি পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। বাকি সময়টা তিনি সেখানেই ছিলেন, তবে শ্বশুর বাড়ি না কারাগারে তা পরিষ্কার নয়। বিজয়ের পর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু ড. কামালকে সাথে নিয়ে আসেন। সাহসের অভাবে হয়তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, তবে তাকে আমি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিই মনে করি। কারণ সারাজীবন তিনি স্বাধীনতার মূল যে চেতনা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লড়াই করেছেন।

Advertisement

সাংবাদিক হিসেবে তার এ লড়াই কাছ থেকে দেখেছি। হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি, তবে তার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে একটা খটকা আমার যায় না। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক কাম্পেইনার ডেভিড বার্গমান ড. কামালের জামাতা। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বনের জন্য ড. কামাল বার্গম্যানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন, এমন কথাও শুনিনি। তাহলে বগলে বার্গম্যানকে রেখে কিভাবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ঐক্য সম্ভব, জানি না।

ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীকেও আমি স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিই মনে করি। যদিও প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বি চৌধুরী দলে থাকার সময়ও বিএনপি স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির আশ্রয়স্থল ছিল। জামায়াত বা স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে বিএনপির মাখামাখির প্রতিবাদে কিন্তু তিনি দল ছাড়েননি। বরং দল তাকে বের করে দিয়েছিল। এখন বিএনপি নেতারা বাসায় গিয়ে সরি বলে তার মান ভাঙ্গিয়েছেন বটে, তবে একসময় কিন্তু কম হেনস্থা করেননি। তবে এটা মানতেই হবে, বিএনপি ছাড়ার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে না পারলেও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। দেরিতে হলেও তার কথাকার্তায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্খা ফুটে ওঠে।

তবে এখানেও একটা ছোট খটকা আছে। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মেজর (অব.) মান্নান বি চৌধুরীর বর্তমান দল বিকল্পধারার মহাসচিব। এখানে প্রশ্নটা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের নয়, একজন হানাদারকে পাশে বসিয়ে কিভাবে তিনি স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির ঐক্য করবেন, ভাবলে আমার হাসি পায়। হাসি মুখ চাপা দিয়ে রাখি। জোরে হাসলে যদি তাদের অসম্মান হয়। পরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে একাত্তরে আ স ম আব্দুর রবের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিত্ব নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই, খটকাও নেই।

মান্না, ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল্লাহ, সাকী, আন্দালিব, জাফরুল্লাহ, এমনকি মাওলানা কাসেমীকেও স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি বলে মেনে নিচ্ছি। তবে আসল প্রসঙ্গটা হলো জামায়াত প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটা খটকার কথা বলে নেই। নাগরিক সমাবেশের সামনের সারিতে ব্যারিস্টার মইনুলের উপস্থিতি বিসদৃশ লেগেছে। বারিস্টার মইনুল স্বাধীনতার পক্ষ না বিপক্ষ, সেটা নিয়ে তর্ক করার দরকার নেই। ব্যারিস্টার মইনুল আসলে পরিত্যাগ পক্ষ। সবারই উচিত তাকে পরিত্যাগ করা, সবার উচিত তাকে ছুঁড়ে ফেলা।

যুক্তফ্রন্টের বি চৌধুরী আর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ড. কামাল অনেকদিন ধরেই বলছিলেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে তারা কোনো ঐক্য করবেন না। তারা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্য বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি তা করেনি, করবে এমন কোনো লক্ষণও নেই। গ্যাড়াকলে পড়া বিএনপি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্য সর্বোচ্চ ছাড় দিতে প্রস্তুত, খালি জামায়াতকে ছাড়বে না। বিএনপির পক্ষ থেকে থেকে ঐক্য প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়েছে, জামায়াতের নিবন্ধন নেই, তাই তাদের থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না।

আর জামায়াত আছে ২০ দলীয় জোটে আছে। কিন্তু বৃহত্তর ঐক্যে বিএনপি যাবে, ২০ দল নয়। যদিও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে ২০ দলের অন্তত চারটি দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত নাগরিকদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের লোকজনও ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন।

বিএনপি আসলে দুই নৌকায় পা দিয়েছে। তারা জামায়াতের ভোট ব্যাংকও চায় আবার ড. কামাল-বি চৌধুরীর ভাবমূর্তির সুবিধাও চায়। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া আসলে বিএনপির ড্রাই ক্লিনিং প্রক্রিয়া। যুগ যুগ ধরে জামায়াতের সাথে থেকে তাদের গায়ে যে দুর্গন্ধ লেগেছে, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে মিশে সে গন্ধ দূর করতে চায়। আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে বেছে নিতে যাদের সংশয়; ড. কামাল-বি চৌধুরীরা সে সংশয় ধুয়ে দিতে চান। তবুও যেন আওয়ামী লীগকে হটানো যায়।

ধরে নিলাম 'স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির এই ঐক্য' নির্বাচন পর্যন্ত গড়ালো এবং ড. কামাল কোনো একটি আসনে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করছেন। তখন তার বাক্সে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যুক্তফ্রন্ট, বিএনপি, বামদের ভোট যেমন পড়বে; জামায়াতের ভোটও কিন্তু পড়বে। তিনি কি তখন তা ফিরিয়ে দেবেন?

শুরুতেই বলেছি, আমি চাই দেশে সব পক্ষই স্বাধীনতার পক্ষ হোক, ভালো মানুষরা জোট বাঁধুক। তবে তা যেন সত্যি সত্যি স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি হয়। আমার খটকাগুলো যেন দূর হয়। যেই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।

এইচআর/জেআইএম